ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার সাইফ আলী (৭১) ও নাজমা খাতুন (৫৭) দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে অনেক আগেই সংসার গড়েছেন। বাড়তি সুখের আশায় যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে একক পরিবার গড়েছেন তিন ছেলে। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি ছোট ও মেজো ছেলের প্রথম সংসার। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন মেজো ছেলে। আর ছোট ছেলেটি এখনো দ্বিতীয় বিয়েতে পা রাখেননি। এভাবে দেশে যৌথ ভেঙে একক হয়েও রেহাই পাচ্ছে না পরিবার। বেড়েছে বিয়ে বিচ্ছেদ ও পারিবারিক কলহের মাত্রা। ধনী-গরিব নির্বিশেষে এমন পরিস্থিতি বিরাজমান।
২০১৭ সালের মার্চে সুনামগঞ্জের তাহেরপুরের লিয়াকত আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ফরিদা আক্তারের। লিয়াকত আলীর মাতা-পিতা দুজনই বেঁচে আছেন। বিয়ের তিন বছর যৌথ পরিবারে ছিলেন লিয়াকত আলী। এখন নতুন ভিটায় উঠেছেন পরিবারর নিয়ে।
স্থানীয় প্রাইমারি সরকারি স্কুলে শিক্ষক লিয়াকত আলী ভোরের আকাশকে জানান, যৌথ পরিবারেই ভালো ছিলাম। কিন্তু যৌথ পরিবার মেনে নিতে পারেননি আমার স্ত্রী। একক পরিবার গড়তে বাধ্য হয়েছি।
যৌথ পরিবার ও একক পরিবারের পার্থক্য তুলে ধরে তিনি জানান, টিকিয়ে রাখতে পারলে যৌথ পরিবারই ভালো। বয়স্ক পিতা-মাতার ছায়ায় থাকা অনেক শান্তির। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার মানুষ থাকে। অনেক সদস্যের সমাগমে মুখরিত থাকে যৌথ পরিবার। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়ার মানুষের সংখ্যা থাকে বেশি। কিন্তু একক পরিবারে ভুল ধরিয়ে দেয়ার কেউ থাকে না। সন্তানেরা তাদের দাদা-দাদি ও অন্য স্বজনদের আদর -ভালোবাসা সব সময় পায় না। নিরিবিলি পরিবেশে সন্তানেরা যেন নিজেদের মত করে বেড়ে উঠছে। যৌথ পরিবারে থাকলে এমনটি হতো না বলে আক্ষেপ করেন লিয়াকত আলী।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি করে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন বেলাল হোসেন। তার সহধর্মিণী ফিরোজা বেগম এখনো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক পদে কর্মরত আছেন। রাজধানীর ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডে তাদের বাসা। তাদের দুই ছেলে সন্তান সংসারি হয়ে একক পরিবার গড়েছেন। বড় ছেলের পরিবার উত্তরায় এবং ছোট ছেলের পরিবার থাকে রামপুর বনশ্রীতে।
বেলাল হোসেন ভোরের আকাশকে জানান, সন্তানেরা সুখে থাকলেই আমরা খুশি। তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে আমরা তাদের পৃথক করে দিয়েছি। বণ্টন করে দিয়েছি সহায় সম্পত্তি। বাসায় কাজের লোক রেখেছি। সময় পেলে ছেলেরা তাদের সন্তানদের নিয়ে বাসায় আসে। নাতি-নাতনি দিনের কাছে পেলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না। তারা চলে গেলে মনে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক বলে জানান বেলাল হোসেন।
এদিকে যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে গিয়েও টিকতে পারছে না একক পরিবার। প্রতি বছর রেকর্ড গড়ছে একক পরিবারের ভাঙন। কথায় কথায় ঘটছে তালাকের ঘটনা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মিরপুর সেনপাড়া এলাকার গামেন্টস কর্মী বিউটি আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় একই কারখানায় কর্মরত রাসেল উদ্দিনের। বিয়ের তিন মাসের মাথায় স্বামীকে তালাকের নোটিশ পাঠান বিউটি আক্তার। চলতি বছরের গত ২৯ এপ্রিল স্ত্রী কর্তৃক তালাকের নোটিশে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, মনের মিল না হওয়া, খোঁজখবর না নেওয়া, ভরণপোষণ না দেওয়া।
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার কালাকুমা গ্রামের সালমা খাতুন ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় কাজ করতে এসে বিয়ে করেন নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার সোহেল রানাকে। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায়ই বসবাস করতেন। সালমা-সোহেলের সংসারে ১ ছেলে ও ১ মেয়ে। সুখেই ছিল তাদের সংসার। তবে গত বছরের শেষদিকে সালমা বাপের বাড়িতে বেড়াতে যান। এরপর থেকেই তার চলাফেরা ও ব্যবহারের ধরন বদলে যায়। হঠাৎ চলতি বছরের জানুয়ারিতে সোহেল রানাকে তালাকের নোটিশ পাঠান। তালাকের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, স্বামী শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে এবং স্ত্রীর মর্যাদা দেন না।
শুধু বিউটি আক্তার বা সালমা খাতুন নন, রাজধানীতে প্রতিদিনই ঘটছে বিবাহ বিচ্ছেদ। ২০২১ সালে রাজধানীতে ১১ হাজার ৯১৯টি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চসংখ্যক তালাক কার্যকর হয়েছে। যার সংখ্যা ৭ হাজার ২৪৫টি। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪ হাজার ৬৭৪টি তালাক কার্যকর হয়েছে। যদিও এই সময়ে ঢাকা উত্তরে তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ৪১৬টি। এর মধ্যে পুরুষ কর্তৃক আবেদন পড়েছে ১৭৬২টি, স্ত্রী কর্তৃক ৪ হাজার ৮১টি এবং আবেদন প্রত্যাহার হয়েছে ১৮৭টি।
অপরদিকে ২০২০ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬ হাজার ৩৪৫টি, উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩ হাজার ৪৪২টি। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে ২ হাজার ১৩২ টি। ২০২১ সালের বিবাহবিচ্ছেদের তালিকা অনুয়ায়ী রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন ৩৩ জনের তালাক কার্যকর হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ৩ ঘণ্টায় ৪টি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে। এছাড়া ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সমাজ গবেষকরা বলছেন, দেশের গ্রামাঞ্চলগুলোতে মাত্র ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে কোনো মতে। আর শহুরে জীবনে যৌথ পরিবার এখন আর চোখেই পড়ে না। ফলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন। উৎসবের বাড়ি বা শোকের বাড়ি ছাড়া কারো দেখা-সাক্ষাৎও হয় না। আবার দেখা হলেও সেখানে ক্ষণিকের কুশল বিনিময়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে সাক্ষাৎ। অথচ অতীতের একান্নবর্তী পরিবারের চিত্র ছিল ভিন্ন, সে যেন এক গল্পকথা। গল্পের প্রধান চরিত্রে থাকতেন দাদা, যিনি হতেন পরিবারের কর্তা এবং তিনি বটবৃক্ষের মতো পুরো পরিবারকে ছায়া দিয়ে রাখতেন। আগলে রাখতেন ঝড়-ঝাপটা থেকে। সংসারের সকল সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন এবং তার সিদ্ধান্তেই সংসার পরিচালিত হতো। এই কর্তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি ছিলেন গল্পের অন্যান্য চরিত্র। সমাজের প্রথা অনুযায়ী কর্তা বাড়ির মেয়ে বিয়ে দিয়ে অন্য সংসারে পাঠাতেন আর ছেলে বিয়ে দিয়ে ছেলের বউ নিজ সংসারে আনতেন। কর্তার স্ত্রী অর্থাৎ দাদি ছিলেন সংসারের কর্ত্রী। সংসার দেখাশোনা ও রান্নাবান্নার দায়িত্ব ছিল ছেলের বউদের। নাতি-নাতনিরা দাদির কাছেই বড় হতো। দাদি ছিল তাদের গল্পবুড়ি। মজার মজার ভূতের গল্প, রাক্ষস আর খোক্ষসের গল্প দাদির কাছে শুনেই বড় হতো এই যৌথ পরিবারের সন্তানেরা। প্রতিটি পরিবার ছিল ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা। তবে এগুলো সবই এখন রূপকথা। ধীরে ধীরে সেই বটবৃক্ষের ছায়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছে পারিবারিক জীবন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.ফাতেমা রেজিনা ভোরের আকাশকে বলেন, যৌথ পরিবার ছিন্ন জীবন সংসার এখন পাখির বাসার মতো। একটি-দুটি ছোট ঘর, ছোট সংসার, ছোট পরিবার; যেখানে বসবাস করে কেবলমাত্র মা-বাবা আর তাদের এক বা দুটি ছেলেমেয়ে। যেখানে নেই তেমন আনন্দ; সবই যন্ত্রের মতো, নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ। পূর্বের সেই যৌথ পরিবারে যারা কর্তা-কর্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন, বর্তমান একক পরিবারে তাদের উপস্থিতি মেহমান হিসেবেই গণ্য করা হয়; ঠিক যেন বাইরের লোক। ফলে তারা যে পরিবারের সদস্য সেটা শিশুরা জানছেই না, ওদের মধ্যে দাদা-দাদি, চাচা-ফুফিদের প্রতি কোনো ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতা গড়ে উঠছে না। এই না জানার মূলে রয়েছে ওদের বাবা-মা।
ড. ফাতেমা আরো বলেন, এই সময়ের পরিবারের সন্তানগুলো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্পকিছু দিনের মধ্যেই তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুইজনের একক পরিবার গড়ে তুলছে; বাদ যাচ্ছে না পরিবারের একমাত্র ছেলেটিও। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতেই আজ তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধাশ্রম। এছাড়াও বর্তমান সমাজে যে অসহযোগিতার চর্চা দেখা যাচ্ছে তার জন্যও খানিকটা এই একক পরিবারব্যবস্থা দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, আধুনিক শিক্ষার প্রভাব, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এই সামাজিক পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি প্রয়োজন। নতুবা মানুষের আন্তরিকতা এবং সম্প্রীতি দিন দিন কমতেই থাকবে। তিনি বলেন, মূলত স্বাধীনতার পর থেকে ভাঙতে থাকে যৌথ পরিবারগুলো।
মন্তব্য