বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলায় ঢাকা- খুলনা সড়কে বাস, প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেলের এক ত্রিমুখী সংঘর্ষে আট জন প্রাণ হারিয়েছে।
এরা সবাই তিনটি পরিবারের সদস্য। খবর-বিবিসি বাংলার।
কাশিয়ানি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ রায়হান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই সাতজন ও পরে হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।
দুর্ঘটনার উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর সময় মিস্টার রায়হান জানান, যে স্থানে দুর্ঘটনা হয়েছে সেখানে সড়কের ওপরেই ধান মাড়াইয়ের কাজ হচ্ছিলো।
ধারণা করা হচ্ছে ধান মাড়াইয়ের কারণে ধান গাছ ও পাতায় সড়কের ওই জায়গাটি পিচ্ছিল হয়ে পড়ে, ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকাগামী একটি বাস, ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জগামী প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
যারা মারা গেছে:
পুলিশ ও স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেট কারে ঢাকার বারডেমের চিকিৎসক বাসুদেব কুমার সাহা ও তার স্ত্রী-পুত্র ছিলেন।
তাদের গাড়িচালকও নিহত হয়েছেন এ ঘটনায়। আর মোটর সাইকেলে আরেকটি দম্পতি ছিলেন। তাদের বাড়ি কাশিয়ানির ফুকরা এলাকায়।
ওই এলাকাতেই দুর্ঘটনাটি হয়েছে। অন্যদিকে ধান মাড়াইয়ের কাজও করছিলো আরেকটি দম্পতি।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের মাহবুব আলম তালুকদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন ধান, পাট ও খড় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি।
এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন।
এ প্রতিষ্ঠানটির হিসেবে প্রতিদিন সড়কে ১৭ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঈদের সময়ে মাত্র পনের দিনে দেশে ৩৭২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪১৬ জন।
তাদের দাবি এ সময়ে দুর্ঘটনার শীর্ষে ছিলো মোটর সাইকেল। গত শনিবার গোপালগঞ্জে যে দুর্ঘটনা হলো তাতে এক সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বাস, প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেলের মাধ্যমে।
সড়কে ধান, পাট ও খড়:
মহাসড়কে ধান, পাট বা খড় শুকানো বা সড়ক মহাসড়ক দখল করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার সড়ক মহাসড়কে বাজার, বাস স্ট্যান্ড ছাড়া নানা জায়গায় দেখা যায় ধান মাড়াই, ধান, পাট কিংবা খড়সহ নানা ফসল শুকানোর কাজ হয় নিয়মিত।
এমনকি সড়কের ওপর গরু ছাগল রাখার দৃশ্যও নিয়মিত চোখে পড়ে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নানা জায়গায়।
রংপুর-দিনাজপুর সড়কে হাইওয়েতে সেদ্ধ আমন শুকানোর খবর বেশ আলোড়ন তুলেছিলো।
সেখানে সড়কের ব্যস্ততম এলাকায় ধান শুকানোর ছবি দেশের প্রায় সব পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে।
রংপুরের কিছু এলাকায় চলতি মাসের প্রথম দিকেও বোরো ধান মাড়াই, খড় ও ধান শুকানোর কাজ করতে দেখা গেছে কৃষকদের।
অথচ এ সড়ক দিয়েই দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও রংপুর জেলার মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেন।
ওই এলাকার অধিবাসী আশরাফ উদ্দিন বলছেন মহাসড়কের একটি অংশে এগুলোর কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনা হয়, কারণ মোটর সাইকেলগুলো, প্রাইভেট কার এমনকি বাসও সহজে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
একই এলাকার শিক্ষার্থী রহিমা আক্তার বলছেন হুট করে ধান চালের সামনে এসে অনেক যানবাহন হিমশিম খায় নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখার জন্য।
কিন্তু এসব নিয়ে এলাকায় কখনো কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি দেখেননি বলে জানান।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের মাহবুব আলম তালুকদার বলছেন এগুলোর বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেই এগুলো বন্ধ হয় না।
‘আইনে এগুলো নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই আইন কে প্রয়োগ করবে। লোকজনকে জানাবে কে যে এটা অন্যায় ও আইন বিরোধী।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাজে লাগালে কিছুটা উপকার পাওয়া যেতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন সরকার সুন্দর সুন্দর রাস্তা করছে নানা জায়গায় কিন্তু এগুলোর ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই।
ফলে যে যার ইচ্ছেমতো ব্যক্তিগত কাজে এগুলো ব্যবহার করে সড়ক মহাসড়ককে ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলেছে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসেবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ৭০ থেকে ৮০ ভাগই হচ্ছে মহাসড়কগুলোতে।
যে কারণে মহাসড়কের নকশায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ ছাড়া মহাসড়কের দুই পাশে ভূমি ব্যবহারের যে নিয়ম কানুন আইনে আছে সেটি প্রয়োগ ছাড়া মহাসড়কগুলোতে নির্বিঘ্ন যান চলাচলের উপযোগী রাখা অসম্ভব বলেই মনে করেন তারা।
এমনকি আইনে আছে মহাসড়কের দশ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা করা যাবে না, কিন্তু সেটি অবাধে লঙ্ঘন হচ্ছে দেশের সর্বত্রই।
আর আইন লঙ্ঘন ও ব্যক্তিগত খেয়াল খুশি মতো ব্যবহারের কারণে দূরপাল্লায় যাতায়াত করতেও অনেকে ভয় পান।
দিনাজপুর থেকে ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াত করেন আফরোজা আক্তার। তার মতে ওই সড়কের কিছু কিছু জায়গায় গরু, ছাগল, ধান সব এক সঙ্গে চোখে পড়ে।
‘মাঝে মধ্যে দেখি দল বেধে ধান চাল নিয়ে মহাসড়কের ওপর কাজ করছে মানুষ। কিভাবে সম্ভব এগুলো? দেখভালের কেউ থাকবে না?’
তার প্রশ্ন। খুলনার শিক্ষক ইশরাত জাহান বলছেন ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ধান পাট শুকানো নিয়মিত দৃশ্য।
‘মাঝে মধ্যে তো অবাকই হই যে চালকরা কিভাবে এগুলো সামাল দেন’।
মন্তব্য