-->
শিরোনাম
চালের বাজার

দাম বাড়ানোর অপেক্ষায় চলছে মজুত

ইফ্ফাত শরীফ ও প্রণব কর্মকার
দাম বাড়ানোর অপেক্ষায় চলছে মজুত
প্রতীকী ছবি

বেলা ১১টা। রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ‘মেসার্স নিউ দয়াময় ভাণ্ডার’ বিশাল চালের আড়ত।

এ আড়তে চালের কোনো কমতি নেই। শুধু দয়াময় ভাণ্ডারই নয়, আশপাশের সব দোকান ও আড়তে নতুন-পুরোনো চালে ঠাসা। দিনভর চাল কেনার মানুষের অভাব নেই।

তেমনি কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একের পর এক ট্রাকে চাল আসতে দেখা যায় রাজধানীর বৃহৎ এ পাইকারি চালের বাজারে।

রাতের ট্রাকে আসা চাল সময় নিয়ে খালাস করা হয় দিনভর।

অথচ গত প্রায় দুই বছর ধরেই অস্থির প্রধান এ চালের বাজার। কোনোভাবেই বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।

ভোক্তাদের অভিযোগ, প্রতি সপ্তাহেই চালের দাম বাড়ে। ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গতবারের মতো এবারো সারা দেশে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে।

বেশিরভাগ জেলার ধান কাটাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। ধান তোলার মৌসুম বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠের শুরু হয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে নতুন চালের দেখা নেই।

পুরোনো চালের দামও অনেক চড়া। বাবুবাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চালের বাজার নিয়ে কোনো সুখবর নেই।

ধান তোলা হলেও কমছে না চালের দর। বরং উল্টোপথে হাঁটতে পারে চালের বাজার।

নতুন চাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই খুচরা পর্যায়ে চালের দাম আরো বাড়বে- এমন ইঙ্গিতই মিলছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দাম বাড়ানোর চিন্তা থেকেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নতুন চাল গুদামজাত করছে। পুরোনো চালও বাজারে খুব বেশি ছাড়ছে না।

বাজারগুলোয় চালের এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরির অশুভ তৎপরতা চলতে দেখা গেছে।

কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নতুন চালের মূল্য বাড়ানোর পর সব পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা চাল সরবরাহ করবে এমন কথাই বলছেন অনেকেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাবু বাজারের এক চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে ভোরের আকাশের কথা হয়।

তিনি বলেন, ‘আমরা তো ছোট আড়তদার। আমাদের কাছে এখনো নতুন চাল আসেনি। দোকানের নামের শেষে ভাণ্ডার লেখা এমন দোকানে গেলে নতুন চাল পাবেন।

ওইসব দোকানগুলোয় নতুন পুরোনো সব চালই পাবেন। কিন্তু এখন তারা কারো কাছে নতুন চাল বিক্রি করছে না। তাই আমাদের কাছেও নতুন চাল নেই।

শুনলাম নতুন চালের দাম এখনো নির্ধারণ হয়নি। দাম ঠিক হলে তারপর আমরা হাতে পাব।’

নতুন চালের দাম কেমন হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে এ দোকানি জানান, ‘এখন আপাতত বাজারে ২৮, মিনিকেট চাল উঠতে শুরু করেছে।

কিছুদিনের মধ্যে বাজারে নাজির, কাটারিসহ অন্যান্য চাল উঠবে। তবে সব ধরনের চালেই পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বাড়বে।

আর খুচরা পর্যায়ে আরো বেশি ৭ থেকে ১০ টাকা বাড়তে পারে বলে জানান এ ব্যবসায়ী। পুরান ঢাকার বাদামতলী ঢাকার অন্যতম বৃহৎ চালের বাজার।

এখান থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চাল সরবরাহ করা হয়। সেখানে গিয়ে জানা জায়, বাজারে শুধু মিনিকেট ও মোটা ২৮-এর নতুন অল্প চাল এসেছে।

যার মধ্যে মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫৯.৫০ টাকায় ও আটাইশ ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। এ দুটির পুরোনো চাল মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকায়, আটাশ ৪৭ টাকায়।

এছাড়া পুরোনো নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়, কাজললতা মোটা ৪০ টাকায় তুলনামূলক সরু ৪৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাদামতলীর একজন চাল ব্যবসায়ী জুয়েল খাঁ। তিনি পাইকারি চাল বিক্রি করেন। তিনি জানান, নতুন চাল বাজারে আসার পরও পুরোনো চাল বস্তা প্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে।

চালের সিজনে দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরবরাহ কম থাকার কারণে চালের বাজার এখন বেশি।

কিছু অসাধু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নতুন করে চালের মূল্যবৃদ্ধি করছে।

এছাড়া বাজারে নতুন চালের তুলনায় পুরোনো চালের চাহিদা বেশি থাকায় পুরোনো চালের এ মূল্যবৃদ্ধি।

এদিকে চাল মজুতের বিষয়ে আড়তদার এবং মিলমালিকরা একে অন্যকে দুষছেন। তবে চালের দাম কেন বাড়ানো হবে এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় নওগাঁর বেশকিছু চালের মিলমালিকদের কাছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক মিলমালিক জানান, ‘আমাদের এখানে আসামাত্রই নতুন ধান ছেড়ে দিচ্ছি।

কোনো ধরনের মজুত করছি না। আর গোডাউনে যা চাল আছে, তার হিসাব প্রতিদিন সরকারি কর্মকর্তাদের দিচ্ছি।

আমাদের এখানে খাদ্য বিভাগ থেকে সবসময় মনিটরিং হচ্ছে। কতটুকু স্টক আছে, কী রেটে বিক্রি করছি, সব হিসাব দিচ্ছি।

আড়তদারদের কাছে তো পুরোনো চাল অনেক আছে, তারা ছাড়ছে না কেন? তাদের এখানে সরকারের প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা প্রয়োজন।

তাহলে তো কিছু হলেও সংকট কমবে।’

দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে কিছু অসাধু চক্র আছে, যারা মিল ভাড়া করছে ঠিকই। কিন্তু চালের কোনো সাপ্লাই দিচ্ছে না।

তারা ধান মজুত করে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। সেই দাম এখন আর কমানো যাচ্ছে না। কারণ এবার অনেক কৃষকের ধান পানিতে নষ্ট হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই কৃষক একটু বেশি দামে বিক্রি করছে। তিনি আরো বলেন, ‘যারা অনেক বছর ধরে এ ব্যবসায় আছে তারা ভেজাল করে না।

তবে এখন বাজারে অনেক নামিদামি বড় কোম্পানি চালের ব্যবসায় এসেছে। ধান কিনতে আমরা যেখানে রেট দিই ১ হাজার ১০০ টাকা।

সেখানে এ কোম্পানিগুলো আমাদের থেকে ১০০-২০০ টাকা বেশি রেট দিয়ে ধান কিনছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা দেশের নামিদামি বড় কোম্পানি এবং রেট বেশি দেওয়ায় তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান বেশি পাচ্ছে এবং মজুতও করছে।

এরা এ ব্যবসার কিছু না জেনেই বেশি মূল্য দিয়ে কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে। তারা একরকম বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না।’

আমনের ভালো ফলন আর সর্বশেষ বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের রেকর্ড হলেও রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো চালের দাম কেজিতে অন্তত ২ থেকে ৫ টাকা করে বেড়েছে।

রাজধানীর পাইকারি বাজার ও বিভিন্ন খুচরা দোকানির সঙ্গে কথা বলে চালের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেলেও অনুসন্ধান দেখো গেছে, চালের দাম বাড়ার বিষয়টি পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের লোভের ওপর নির্ভর করে।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় দাম বাড়ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, আগাম বন্যায় নিম্নাঞ্চলে ধান নষ্ট হওয়ায় দাম বাড়ছে।

আর খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ পাইকাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বৃদ্ধি করছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৮ টাকায়।

নাজিরশাইল ৭৫ টাকায়। মোটা ২৮ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। মাঝারি আকারের পাইজাম চালের দাম প্রতিকেজি ৫৫ টাকা।

এক মাস আগেও প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকায়। নাজিরশাইল ৭২ টাকায়। মোটা ২৮ বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকায়।

মোহাম্মদপুরের ভোলা স্টোরের বিক্রেতা খলিল মিয়া বলেন, গত এক মাস ধরে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের বাজার বেশি বাড়তি।

সেজন্য বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। চালের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালের ৫০ কেজির বস্তা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

বাজারে মিনিকেট চালের বস্তা এখন ৩ হাজার টাকার বেশি। বাজারে পুরোনো চাল নেই বললেই চলে।

আমরা ছোট ব্যবসায়ী যেমন ক্রয় করি, তার চেয়ে কিছু লাভ রেখে বিক্রি করি।

ভোক্তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রিত না হলে, জীবনের চলার হিসাব মেলানো কঠিন হবে।

মন্তব্য

Beta version