-->

একুশের গানেই চির ভাস্বর আবদুল গাফফার চৌধুরী

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
একুশের গানেই চির ভাস্বর আবদুল গাফফার চৌধুরী
ফাইল ফটো

সালটা ১৯৫২। আবদুল গাফফার চৌধুরী তখন আঠারোর টগবগে যুবক। পড়েন ঢাকা কলেজে। বসয়টা রঙ্গিন চশমা পরার। বয়সটা রঙ্গিন স্বপ্ন ধরার। কিন্তু সে দিকে তার মন নেই। তিনি যেন অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা, একটু পরিনত। তার মন কাঁদে দেশের জন্য। মন কাঁদে ভাষার জন্য। কারণ মায়ের ভাষা বাংলা রক্ষার দাবিতে তখন উত্তাল সারাদেশ। চলছে মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা। যা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে আলোচনা। ঘুম নেই বাঙালি জাতির।

ঘটনাক্রমে সে বছরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়; এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। এই মিছিলে আবদুল গাফফার চৌধুরীও ছিলেন। গুলি শুরু হলে তিনি মেডিকেল হোস্টেলের ভিতর আশ্রয় নেন। পরে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। অজান্তেই তার দু’চোখ ভিজে ওঠে। তৎক্ষণাৎ তার মনে দুইটি লাইন জেগে উঠে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কী ভুলিতে পারি’। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে কবিতাটি লেখা শেষ করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে সংকলনে’ও এটি প্রকাশিত হয়। এই এক গানেই কোটি কোটি বাঙালির মন জয় করে নেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। চিরতরে আসন গেড়ে বসেন বাঙালির হৃদয়ে।

গতকাল অসীমে পাড়ি জমানো আবদুল গাফফার চৌধুরী একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও সাহিত্যিক। তবে সব পরিচয়-সৃষ্টি ছাপিয়ে তার লেখা একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র জন্য বিশেষ ভাবে জাতি তাকে স্মরণ করে। আব্দুল লতিফ গানটির সুরারোপ করেন। তিনি তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। গানটি গাওয়া ও লেখার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরিতে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিল। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান।

ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায়। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।

একবার গানটির পেছনের গল্প আবদুল গাফফার চৌধুরী তুলে ধরেন বাংলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানের বক্তব্যে। গল্পটি এমন- ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার তৎকালীন প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবনের (বর্তমান জগন্নাথ হল) সামনে গুলি বর্ষণ করা হয়। শহীদ রফিকের লাশ পড়ে আছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের বারান্দায়। তার মাথার খুলি উড়ে গেছে গুলিতে। এই খবর শুনে গাফফার চৌধুরী তার বন্ধুরা মিলে ছুটে যান হাসপাতালে। শহীদ রফিকের লাশ দেখে তার মনে শোকে-আবেগে গুঞ্জরিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। হাসপাতালের পাশে মেডিকেল কলেজের ব্যারাক-হোস্টেলের সামনে তখন ছাত্র-জনতার ভিড়। সে সময় গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয় তার এক বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের সঙ্গে।

তিনি জানতে চান, গাফফার চৌধুরী কি মিছিলে ছিলেন? তখন তিনি বলছেন, হ্যাঁ ছিলাম। গুলি শুরু হতেই মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর আশ্রয় নেই। এখন হাসপাতালের বহির্বিভাগের মেঝেতে একজন শহীদের মৃতদেহ দেখে এলাম। তাকে দেখে মনে হয়েছে, আমার আপন ভাই। মনে মনে একটি কবিতার লাইনও তৈরি হয়েছে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।

তখন কবিতার লাইনটি শুনে আহমদ হোসেন তার হাত চেপে ধরে বললেন, এই কবিতাটি এখনই লিখে ফেলুন। গাফফার চৌধুরী বললেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি কবিতা লেখা যায়? হোস্টেলে ফিরে গিয়ে লিখব। তখন আহমদ হোসেন বললেন, আপনি হেঁটে আরমানিটোলা পর্যন্ত যেতে যেতে কবিতাটি হারিয়ে যাবে। পরবর্তীতে লেখা হয় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো অমর সৃষ্টি।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০। এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে আছে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’। এই সাংবাদিক স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৬ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে ‘বাংলার ডাক’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পরে তিনি ‘নতুন দিন’ ও ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকা বের করেন।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গাফফার চৌধুরী। ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক, শেরে বাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ আরো অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন।

মন্তব্য

Beta version