-->
শিরোনাম

নিত্যপণ্যে দীর্ঘশ্বাস, পেরে উঠছে না সাধারণ মানুষ

জাফর আহমদ ও ইফ্ফাত শরীফ
নিত্যপণ্যে দীর্ঘশ্বাস, পেরে উঠছে না সাধারণ মানুষ
ফাইল ফটো

নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। বৈশ্বিক মূল্য পরিস্থিতি ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ঘায়ে প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে টাকা। কমছে টাকার মান। ফলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। কম খেয়েও আর সামাল দিতে পারছে না। খুঁজছে কম দামের পণ্য। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র মিলেছে।

বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার ও চালের ধরন ভেদে বেড়েছে ৪ থেকে ৮ টাকা । রাজধানীর গোড়ান, খিলগাঁও ও সেগুনবাজারে দেখা যায়, আঠাশ, মিনিকেট এবং নাজিরসাইল চালে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৫০ কেজির বস্তা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। আঠাশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। নাজির বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। অন্যদিকে পোলাওয়ের চালে কেজিতে ৬ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে।

এ সপ্তাহ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে প্রায় সব ধরনের মাছ। আকারভেদে রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। তেলাপিয়া ২০০ টাকায়, পাঙ্গাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। শিংমাছ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে। শোল মাছ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায় এবং কৈ মাছ পাওয়া যাচ্ছে ২০০ থেকে ২৩০ টাকা কেজিতে। পাবদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। বোয়াল মাছ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। বাইম ৯০০ টাকা কেজি। কাছকি মাছ ৫০০ টাকা কেজি। বড় গলদা চিংড়ি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। কাইক্কা মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। পোয়া মাছ ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।

বাজারে মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় আছে বেগুন, কাঁচকলা, কচুরমুখী, পেঁপে, গাজর, বরবটি, কাঁকরোল এবং টমেটো। ঈদের আগে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া টমেটো এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া কাঁচা পেঁপে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। আর ৩০ টাকার কাঁচাকলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। আলু ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি। ঈদের আগে ৩০ থেকে ৪০ টাকার গাজর এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। কাঁকরোল ৭০ টাকায়। বরবটি ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। কচুরমুখী ৭০ টাকায়।

অন্যদিকে পটোল, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে, চিচিঙ্গার দাম একই রয়েছে। বাজার ভেদে পটোলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। ঢ্যাঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। ঝিঙে ও চিচিঙ্গার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। লেবুর হালি ২৫ টাকা।

মূল্যবৃদ্ধির এ চিত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকাতেই তুলে ধরা হয়েছে। রাজধানীর বাজারের ৩২ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠানামার হিসাব রাখে। সংস্থাটির গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের ব্যবধানে বাজারে ৩২ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ১৯টির দাম। কমেছে শুধু একটি পণ্যের দাম। ১২টি পণ্য এক মাস আগে বৃদ্ধি পাওয়া দামে বিক্রি হচ্ছে।

টিসিবির তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে মোটা চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, পামঅয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা ও ডিমের দাম বেড়েছে। বাজারে শুধু কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা গত মাসের থেকে বর্তমানে কেজিতে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সরবারহ না থাকাকে দায়ী করছে পাইকারি বাজারের বিক্রেতারা।

আমদানিকারকরা বলছেন, আমদানি মূল্য, পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়া এবং দেশে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যমূল্য বাড়ছে। এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে মতিঝিলের ব্যাংক ও খোলাবাজারের ডলার ব্যবসায়ীরা।

তবে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, যেখানে হাত দিচ্ছি সেখানেই অনিয়ম ধরা পড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজার ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তারা ব্যক্তিগত মুনাফা করার চেষ্টা করছে। মজুদদারদের বিরুদ্ধ অভিযান না চালালে পরিস্থিতি আরো নাজুক হতে পারত। বাজার পরিস্থিতিকে সামাল দিতে আগামীতে এ ধরনের অভিযান চলবে।

মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় শুকনো ও মশলাজাতীয় পণ্যও বাদ যায়নি। রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি জিরায় বেড়েছে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে যেখানে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হত ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়। এ সপ্তাহে সেই জিরা বিক্রি হচ্ছে ৪১৫ থেকে ৪২০ টাকায়। প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, আমদানি করা আদা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ডিম ১১৫ থেকে ১২০ টাকা ডজন। দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকা। দেশি মসুর ডাল বিক্রি করছে ১৩০ টাকায়, মোটা ইন্ডিয়ান ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। লবণ বিক্রি ৩৫ টাকায়। খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।

প্রতি ১০০ গ্রাম এলাচ বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকায়। তেজপাতা ২০ টাকায়। লং ১২০ টাকায়। কালো গোলমরিচ ৭০ টাকায়। সাদা গোল মরিচ ১০০ টাকায়। দারচিনি ৪০ টাকা। কালোজিরা ৩২ টাকা। ধনিয়া ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিশমিশ ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাপড় ধোয়ার গুঁড়া সাবানে কেজি প্রতি ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। সুগন্ধি সাবান এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ টাকা বেড়েছে। যে সাবান ৩৫ টাকা ছিল তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। আর ৪০ টাকার সাবান বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়।

করোনা শিথিল হয়ে আসার অব্যবহতি পর পরই বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে চাহিদার বেড়ে যায় সব ধরনের পণ্য ও সেবার। কিন্তু চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন না হওয়া ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় পণ্য ও সেবার এ দাম বৃদ্ধি পায়। এর থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলে। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। রাজধানী থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই মূল্য বৃদ্ধির আঘাত লাগে। পণ্যমূল্য কমানোর জন্য ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনাসহ সরকার উদ্যোগ নিলেও খুব একটা কাজে আসেনি। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মজুদ করে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে। সরকার এই মজুদদারির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা ও মজুদদারির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দেয়। তারপরও দেখা যায় এসব পণ্যের দাম বেড়েছে।

সেগুনবাগিচার সিটি করপোরেশন বাজারের ক্রেতা রফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আগেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। আয় দিয়ে আর চলছে না। এখন কম দামে পণ্যের দিকে যেতে হচ্ছে।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। বাজার পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব কারণ কাজ করছে, বিশেষ করে ডলার বাজার ও আমদানি পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অসৎ উদ্দেশ্যে ডলারের বাজার অস্থির করার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিম। এর সুফলও পাওয়া গেছে। আগামীতে যাতে কৃত্রিম উপায়ে কেউ আমদানি পরিস্থিতিকে ব্যবহার না করতে পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

মন্তব্য

Beta version