অসময়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট। বন্যায় ডুবে আছে পুরো শহর ও গ্রামের এই জনপদ। লাখ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রশ্ন হলো অসময়ে সিলেটে হঠাৎ কেন এই ভয়াবহ বন্যা। কেনইবা এবার হাওর এলাকায় এবার ফসলডুবির ঘটনা ঘটছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে সিলেট অঞ্চলে এই ধরনের বন্যা আশঙ্কা থাকে। তবে প্রতি বছর এই আশঙ্কা থাকে না। প্রতি ১০ বছর বা ২০ বছর পরপর এই ধরনের বন্যার আশঙ্কা দেখা দেয়। এবারেও এই ধরনের বন্যায় দেখা দিয়েছে প্রায় ১৫ বছর পরে।
তারা জানান, একই কারণে প্রতি চার বছর পরপর সুনামগঞ্জসহ হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যায় ফসলহানির ঘটনা ঘটে, যা এ বছরও ঘটেছে।
কেন ঘটে এমন ঘটনা? বিশেজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে সাধারণত কালবৈশাখী এবং বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই বৃষ্টিতে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে এই এলাকায় কখনো বন্যার আশঙ্কা থাকে না। তবে উজানে আসাম, মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় কখনো কখনো অতিবৃষ্টি হয়ে থাকে। এই উজান থেকে নেমে আসার পানির কারণে সিলেটে এমন বন্যা দেখা দিয়েছে।
তবে এই বন্যার প্রভাব ভাটিতে পড়ে না। বা দেশে অন্য এলাকায় পড়বে না। তারা জানান, এর সঙ্গে সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় এলাকায় প্রভাব পড়লেও পাহাড়ি এই জনপদে বন্যার আশঙ্কা থাকে না।
তারা জানান, ভারতের মেঘালয়ে অবস্থিত চেরাপুঞ্জি। এই শহরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। এখানে বৃষ্টি নিত্যদিনের বিষয়। মেঘ, বৃষ্টি আর ঝরনার শহর এটি। যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এছাড়া আসামের পাহাড়ি এলাকায় মাঝে মাঝে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার ঘটনা ঘটে সিলেটের এই জনপদে। তারা জানান, বর্তমানে চেরাপুঞ্জিতে গড়ে এক বছরে ১৮০ দিন বৃষ্টি হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু মেঘালয় এবং আসামে ১০ বছর বা ২০ বছরের ব্যবধানে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অতিবৃষ্টির দেখা মেলে। এবারো চৈত্র ও বৈশাখে অতিবৃষ্টির কারণে দেশে হাওরাঞ্চলে ফসলডুবির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বৈশাখের শেষে এবং জ্যৈষ্ঠের শুরুতে সেখানে অতিবৃষ্টি শুরু হয়।
অতিবৃষ্টির এই পানি উজান থেকে মেনে আসার কারণে এবার সিলেটে আগাম বন্যা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অফিসের জ্যৈষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, এবার দেশের উজানে আসাম এবং মেঘালয় এলাকায় অতিবৃষ্টির হচ্ছে। সেখান থেকে পানি মেনে এসে আগাম বন্যা দেখা দিয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাধারণ স্বাভাবিক বন্যা হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে।
এই সময়ে সব নদীর পানিই বাড়তে থাকে। নদীর পানি অনেক সময় উপচে দুই কূল ছাপিয়ে জনপদে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে। এই সময়ে হিমালয়ে থেকে নেমে আসা পানি এবং বৃষ্টির কারণে অতিরিক্ত পানি নদীর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে বন্যা আশঙ্কা এমনিতে তৈরি হয়।
কখনো কখনো তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সাধারণ বন্যার সময়। কারণ এই সময়ে মৌসুমি বায়ুর কারণেও দেশে অধিক বৃষ্টি হয়। কিন্তু বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে মৌসুমি বায়ুর কোনো প্রভাব থাকে না। এই সময়ে উজানে অতিবৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। আগাম বন্যা দেখা দেয়।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, দেশের প্রধান প্রধান নদীর পানি বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এ কারণে সিরাজগঞ্জের শহর রক্ষাবাঁধ এবং নির্মাণাধীন বাঁধ ধসে গেছে যমুনা নদীতে। হঠাৎ করেই পদ্মা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের যান পারাপারে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তারা জানান, পানি বাড়ার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বন্যা দেখা দিতে পারে এবার।
পাউবো জানায়, সিলেটে উজানের ঢল, টানা বৃষ্টিতে বন্যার স্রোতে ভেসে গেছে ঘর, আসবাবপত্র, গবাদিপশু। বন্যায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ায় এলাকাবাসীরা দুর্বিষহ দিন পার করছেন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এর আগে ২০০৪ সালে তাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল। পাউবোর কর্মকর্তারা জানান, উজানে অতিবৃষ্টির কারণে সিলেট জেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ৩৪টি বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলা কমপ্লেক্সে। এসব উপজেলার অনেক বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি ওঠায় আশ্রিতরা বিপাকে পড়েছেন।
মন্তব্য