ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে অপরাধীরা। প্লাটফর্ম হিসেবে বেছে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান থেকে রক্ষা পেতে এই পথে হাঁটছে তারা। অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে মাদক ও একশ্রেণির নারীদের। মাদকের বিষয়টি গোপনে বা সাঙ্কেতিক ভাষায় প্রকাশ হলেও সরাসরি ভাড়া হচ্ছে নারী মডেল। এ রকম বিজ্ঞাপন ও ফেসবুক পেজ অনেক। প্রায়ই ঘটা করে রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে, রিসোর্টে এসব অপরাধী আয়োজন করে নাচ-গানের। এসব উৎসবে মাদক সেবন থেকে শুরু করে ঘটে নানা অনৈতিক কার্যকলাপ। নিকেতন, গুলশান, বনানী ও উত্তরার বিভিন্ন আবাসিক ভবনেও আয়োজন করা হয় এসব পার্টির। কোনো কোনো স্পা সেন্টারের আড়ালেও চলছে এসব অপকর্ম। এসবের মূল প্রচারণা হচ্ছে অনলাইনে। মাঝেমধ্যে জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও এই বাণিজ্য দিন-দিন বেড়েই চলছে। এর শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা।
উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৯ নম্বর সড়কের বহুতল একটি বাড়ি। এর চতুর্থ তলায় প্রায়ই আয়োজন করা হয় এ রকম পার্টির। একইভাবে টঙ্গী স্টেশন রোডের একটি হোটেলে নাচ-গানের নামে আয়োজন করা হয় মাদক পার্টির। খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকার ১৯ নম্বর সড়কের একটি বাসায় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত এক নারীর বাসায়ও আয়োজন করা হয় এমন পার্টির। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় এ রকম হাজার হাজার পার্টির আয়োজন করা হয়। এসব পার্টির মাধ্যমে মরণনেশার বাণিজ্য বিস্তৃত করা হয়। তবে পার্টির বাইরে প্রতিদিন মাদক বিক্রি হয় ভিন্ন কৌশলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেছে নেওয়া হয়েছে মাদকের নতুনবাজার। অনলাইন। অনলাইনে মিলছে মাদক। ইয়াবার পর মরণনেশার বাজারে এখন যুক্ত হয়েছে আইস। মাদকসেবীদের কাছে ভয়ঙ্কর এই দুটি মাদকের বিপুল চাহিদা। মাদক প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তায় কারবারিরা ঘনঘন পাল্টাছে কৌশল। প্রকাশ্যে সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার থেকে শুরু করে, নির্দিষ্ট স্থানে বিক্রি, হোম ডেলিভারি এমনকি অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে মাদক। বিভিন্ন নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক কারবারে জড়িত অন্তত অর্ধশত গ্রুপ রয়েছে। মূলত পরিচিতরা এসব গ্রুপের সদস্য। কোনো কোনো মাদক কারবারি নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অ্যাপসের মাধ্যমে বিক্রি করছেন মরণনেশা। এতে পরিচিত ক্রেতাদের নিয়ে গ্রুপ করছেন। বিশেষ দিন উপলক্ষে মাদকসেবীদের নিয়ে পার্টির আয়োজন করা হয়। এতে মাদক এবং একান্ত সঙ্গী হওয়ার জন্য একশ্রেণির নারী থেকে শুরু করে থাকে নাচ-গানের আয়োজন।
কিছু পেজ রয়েছে যেখানে সরাসরি ‘মডেল ভাড়া হবে’ বলে প্রচারণা চালানো হয়। ঢাকা রিয়েল সার্ভিস বিডি নামে এমন একটি পেইজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে অনলাইনে একশ ভাগ বেস্ট কোয়ালিটি রিয়েল সার্ভিস ও ফুল সেফ্টি-সিকিউরিটি সম্পূর্ণ একমাত্র এই এজেন্সি। দীর্ঘ চার বছরে আমাদের এজেন্সি থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার ক্লাইন্ট তাদের স্থানে বা আমাদের স্থানে এসে সার্ভিস নিয়েছে। আমাদের এই চার বছরে অর্জন দুই হাজার ভেরিফাইড মেম্বার, পাঁচ শতাধিক মডেল গার্ল, পেইজ, ইনস্টাগ্রাম, বিশ্বস্ততা, সাপোর্ট ইত্যাদি। যারা সার্ভিস নিতে ইচ্ছুক। তারা এখনই এই মাসের অফারে ফি দিয়ে মেম্বারশিপ গ্রহণ করে সার্ভিস জন্য কনফার্ম করুন।’
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এসব পেজের বিজ্ঞাপনে অগ্রিম টাকা দিয়ে অনেকে প্রতারণারও শিকার হচ্ছেন। অনলাইনে মাদক বিক্রির ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করছে কেউ কেউ। আবার কোনো গ্রুপ পরিচালনা করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। বিশেষ করে পাশর্^বর্তী দেশ ভারত ও মালয়েশিয়াকেন্দ্রিক গ্রুপ রয়েছে বেশি। এমনকি মাদক ব্যবসায় জড়িত তরুণীরাও সেসব গ্রুপের এডমিন। নানা রকম নামে পরিচালনা করা হচ্ছে এসব গ্রুপ। ফেসবুকে এমন অনেক গ্রুপ রয়েছে। কিছুদিন পরপর এসব গ্রুপের নামও পরিবর্তন করা হচ্ছে। আড্ডাবাজ, রিয়েল সার্ভিস, ঢাকা সার্ভিস, মডেল সার্ভিস, আমরা শান্তি চাই, রঙিন দুনিয়া, ওম শান্তি, জাস্ট এনজয়, এসো মজা করি। এ রকম নানা নামে পরিচালিত হচ্ছে এসব গ্রুপ। মাদকের অর্ডারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে সাংকেতিক নাম। কোনো কোনো গ্রুপে সাংকেতিক নামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কোড নম্বর। ইয়াবা ও আইসের সাঙ্কেতিক নামের মধ্যে রয়েছে, আপেল, কমলা, চায়না কমলা, ইন্ডিয়ান কমলা, ট্যাবলেট, লালবাবা, দুধ, সাদা ভাত, চাইনিজ, গোলাপী, বড়ি ইত্যাদি।
শ্যামলী মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে হোম সার্ভিস দেয় একটি চক্র। এই চক্রের হোতাদের একজন পাপিয়া। জানা গেছে, পাপিয়া ও তার স্বামী জয়নাল দু’জনেই মাদক কারবারি। চট্টগ্রাম থেকে মাদক এনে ঢাকায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে এই চক্র। একাধিকবার কারাভোগ করেছে এই মাদক কারবারিরা। জেল থেকে বের হয়ে আবারও একই বাণিজ্যে জড়িত হয়ে যায় এই চক্র। ঢাকা সার্ভিস নামে একটি গ্রুপে কথা হয় পিয়াল নামে এক তরুণের সঙ্গে। প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন। জানান, এটা জাস্ট ফান গ্রুপ। মাদক বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না। এ সময় তাদের একজন ক্রেতার রেফারেন্স দিলে তিনি জানান, ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার পর নিশ্চিত হয়ে এ বিষয়ে কথা বলবেন তিনি। সূত্রমতে, এরকম অর্ধশত গ্রুপ রয়েছে, যারা অনলাইনে মাদক বিক্রি করে।
গোয়েন্দারা জানান, টেকনাফ থেকে ইয়াবা ও আইস এনে তা গোপন চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে উচ্চবিত্তদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। একই চক্র মাদক বিক্রির পাশাপাশি এস্কট বা অন্যান্য অনৈতিক কারবারও চালাচ্ছে। তারা নতুন মাদকের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছে। সূত্রমতে, নতুন মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস কারবারচক্রের অন্যতম জবির খান, শাকিল ও ইডেন। জবির খান দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে ছিলেন। সেখান থেকেই ঢাকায় মাদক কারবার শুরু করেন। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব। বর্তমান সময়ে আলোচিত ভয়ংকর মাদক আইসের বিরুদ্ধে র্যাব নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ইতিমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। একইভাবে অভিযান পারিচালনা করছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ডিএনসির উপপরিচালক (উত্তর) রাশেদুজ্জামান বলেন, টেকনাফ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকায় মাদক আনা হচ্ছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে।
মন্তব্য