-->

চাঙা অর্থনীতির ডাক শোনাচ্ছে পদ্মা সেতু

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
চাঙা অর্থনীতির ডাক শোনাচ্ছে পদ্মা সেতু

পদ্মাকে বলা হতো সর্বনাশা। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের কাছে এটা সত্যিই সর্বনাশা পদ্মা নদী। পদ্মার সঙ্গে তাদের কষ্টের স্মৃতির শেষ নেই। সময় মতো জলযান না পাওয়ায় এই নদীর পাড়েই তাদের কেটে গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঝুম বর্ষা, প্রবল স্রোত কিংবা ঘন কুয়াশায় পদ্মার পাড়েই কেটে গেছে দিন-রাত। সময়মতো বাড়িতে পৌঁছাতে পারেনি বলে শেষবারের মতো দেখা হয়নি মৃত স্বজনের মুখ। অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেছে রোগী। চোখের সামনেই পরিবহনে নষ্ট হয়েছে কৃষকের কষ্টের ফসল। নানাবিধ কারণে দীর্ঘকাল থেকে পদ্মা পাড়ের মানুষের দাবি ছিল পদ্মার বুকে একটি সেতু হোক। ২৫ জুন আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। খুলে যাচ্ছে স্বপ্নের দ্বার। এতে আমূল বদলে যাবে তাদের জীবনমান। চাঙা হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। তারা এখন শুনতে পাচ্ছেন চাঙা অর্থনীতির ডাক।

# খুলবে সামাজিক উন্নয়নের দ্বার

# কমবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য

# হবে দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোন

# বাড়িতে থেকে ঢাকায় কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে

বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে ২৫ জুন। সেদিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। স্বপ্নের সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে সেতুটি। খুলবে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের দ্বার। আরো সহজ হবে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। এ অঞ্চল হবে দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোন।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে সংযোগ সড়কের সঙ্গে চালু হয়েছে ছয় লেনও। শুধু যোগাযোগই নয়, নদীর দুই পাড়ে কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। এমন স্বপ্ন বাস্তবে দেখার আশায় দিন গুনছেন এ অঞ্চলের কৃষক, যুবক, শ্রমিক, কর্মজীবী, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা হচ্ছে- খুলনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ , মাগুরা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর যাতায়াতের সময় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা কমে আসবে। পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টা। এতে একদিকে যেমন ভোগান্তি কমবে, তেমনি যাত্রাও সহজ হবে। বর্তমানে মাওয়া-জাজিরায় পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে ফেরিতে দেড় ঘণ্টার মতো সময় লাগে। আর আরিচা-পাটুরিয়ায় সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতো। সমস্যা হলো, ঘাটে গিয়েই ফেরিতে ওঠার নিশ্চয়তা নেই। কখনো কখনো বাস দিন-রাত ঘাটে বসে থাকে ফেরিতে উঠতে। সেতু চালু হলে সেই সমস্যা আর থাকবে না।

পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে তারা ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টায় এসব জেলায় যেতে পারবেন। বর্তমানে ২ থেকে ৩ দিন ফেরিঘাটে বসে থাকতে হয়। খাওয়া দাওয়া, গোসল, ঘুম সবকিছুতেই কষ্ট করতে হয়। ব্রিজ চালু হলে সবকিছু শর্টকাটে হবে বলেও আশাবাদ এসব শ্রমিকের। ঢাকায় সরাসরি উৎপাদিত পণ্য বিক্রির আশায় বুক বেঁধেছেন প্রান্তিক কৃষকরা। দক্ষিঞ্চালের কৃষকরা বলছেন, পদ্মা সেতু হলে আমরা সরাসরি সবজি ঢাকা নিয়ে বিক্রি করে লাভবান হতে পারব।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নড়াইল কৃষক সমিতির আহবায়ক খন্দকার শওকত ভোরের আকাশকে বলেন, পদ্মা সেতু এত দিন আমাদের কল্পনায় ছিল, এখন তা বাস্তবে পাচ্ছি। এটা নড়াইলসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে খুশির খবর। বিশ্বাস করি, সেতু চালু হওয়ার পর এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে। এখনো এ অঞ্চলের মানুষ তাদের কষ্টের ফসলের সঠিক মূল্য পায় না। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে তাদের অনেক কম মূল্যে ধান, গম, সবজিসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করতে হয়। সেতু চালু হলে এই সমস্যা আর থাকবে না। প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য বদলের সুযোগ হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে।

একই বিষয়ে নড়াইলের নাকোশী গ্রামের তাজিনুর রহমান বলেন, আমাদের তিনটি মাছের ঘের রয়েছে। সারা বছর মাছ চাষে যে ব্যয় হয় বেশির ভাগ সময় তা ওঠে আসে না। কখনো লোকসানও গুনতে হয়। কারণ আড়তদাররা মাছের দাম খুব কম দেয়। তাদের চক্র রয়েছে বলে আমাদেরও কিছু করার থাকে না। তারা যে দরে মাছ কিনে ঢাকায় নিয়ে তার দ্বিগুণেরও বেশি দরে বিক্রি করে। সেতু চালু হলে আমরা নিজেই ঢাকায় নিয়ে মাছ বিক্রি করে আসতে পারব। এতে আমাদের লাভও বেশি হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালুর খবর আমাদের কাছে ঈদ আনন্দের চেয়ে খুশির খবর।

এদিকে পদ্মা সেতুর সঙ্গে ১৪ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সিক্স লেনও চালু করা হয়েছে। এই সেতুকে ঘিরে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, শেখ হাসিনা হেলথ টেকনোলজি, শেখ রাসেল আইটি পার্কসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের চাকা। কর্মসংস্থান পাবেন এই অঞ্চলের বেকার যুবকরা। এক সমীক্ষা বলছে, এখানে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আর সেতু দ্বারা সরাসরি উপকৃত হবে তিন কোটি মানুষ। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর জিডিপি ১ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে।

শুধু অর্থনৈতিক নয়, সেতু চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবনের অনেক ভোগান্তি কমে আসবে। দ্রুত চিকিৎসার জন্য তারা সহজেই ঢাকাতে আসতে পারবেন। ইচ্ছে হলেই শপিং করতে ঢাকায় চলে আসতে পারবেন। রেল চালু হলে এসব জেলার মানুষের ঢাকায় অফিস করে বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

এ প্রসঙ্গে শেখ নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমার বাড়ি মুকসুদপুর। একবার আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত ঢাকায় নেওয়া দরকার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় নদী। সময়মতো ফেরি না পেলে মাকে বাঁচানো মুশকিল। আমার এক আত্মীয়কে বিষয়টি জানাই। তিনি আমাদের জন্য ফেরিটি চল্লিশ মিনিট দেরি করান। আমরা এলেই ফেরি ছাড়ে। ফেরিতে এসে আমার কষ্ট আরো বাড়ে। সেই ফেরিতে আরো দুই-তিনজন রোগী আছেন। আমাদের জন্যই সেই রোগীগুলো কষ্ট পাচ্ছিলেন। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। সেতু চালু হলে আমাদের এসব ভোগান্তি আর থাকবে না। আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছি।’

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ধরা হয়েছিল ২০১৩ সাল। প্রকল্পের অর্থ ঋণ হিসেবে জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাঁচটি সংস্থা।

এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর জাইকার দেওয়ার কথা ছিল ৪১ দশমিক ৫ কোটি ডলার। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ জুন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ২০১২ সালের ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।

পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেতুটি জুনেই যান চলাচলে উপযোগী করতে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। ধাপে ধাপে সব কাজই সম্পন্ন হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় এখন ফিনিশিংয়ের কর্মযজ্ঞ চলছে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এবং নামকরণের বিষয়ে সারসংক্ষেপ নিয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গণভবন যান সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পরে তিনি সাংবদিকদের বলেন, ‘বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু, সেটা কবে উদ্বোধন হবে জানার আগ্রহ সবার মধ্যে। সেই সুসংবাদ আপনাদের দিচ্ছি। ২৫ জুন শনিবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করবেন।’

সড়ক পথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটটি ১৯৮৬ সালে চালু হয়। যেটি বর্তমানে মাদারীপুরের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই নৌরুটে শীতে ঘন কুয়াশা, বর্ষায় তীব্র স্রোতে ও গ্রীষ্মে নাব্য সংকটে নৌযান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় ঘাটে আটকা থেকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। দক্ষিণাঞ্চলের তিন কোটি মানুষ আশায় বুক বেঁধে আছেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।

পদ্মা সেতুর যাত্রাপথ সহজ ছিল না। প্রতিটি কাজে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বের প্রথম স্প্যান বসলেও পুরো ৪১টি শেষ করতে লাগল তিন বছর তিন মাস।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়াতে সহায়তা করবে।

এছাড়াও সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাড়বে জিডিপি। দারিদ্র কমবে এক দশমিক নয় শতাংশ হারে। সেইসঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থান ও বিদেশী বিণিয়োগ। সিঙ্গাপুর ও চিনের সাংহাই শহরের আদলে গড়ে তোলার হবে পদ্মা আশপাশের এলাকা। প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে পদ্মার দু’পাড়ের নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোতে; এমন প্রত্যাশা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।

মন্তব্য

Beta version