বৈধ গোডাউনের বাইরে দেশে কেমিক্যাল মজুত ও পরিবহণের কোনো নীতিমালা নেই। দেশে ব্যবহৃত মোট কেমিক্যালের ৯৫ ভাগই আমদানি করতে হয়। ইটালি, চীন, ভারত, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, তুরস্কসহ পৃথিবীর ১৫/২০টি দেশ থেকে এসব কেমিক্যাল আমদানি করা হয়। আমদানি করা কেমিক্যাল মজুতের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদিত গোডাউন থাকতে হবে। বিস্ফোরক অধিদপ্তর কর্তৃক ৩১ ধরনের কেমিক্যালকে ‘অতিদাহ্য’ বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ৩১ ধরনের কেমিক্যাল আমদানি ও মজুতের অনুমতি বিস্ফোরক অধিদপ্তর দিয়ে থাকে।
এই ৩১ ধরনের অতিদাহ্য কেমিক্যালের বাইরে আরো বহু ধরনের কেমিক্যাল আমদানি করা হয়। এমনকি এসব কেমিক্যাল সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সের বিপরীতে আমদানি ও মজুত করা হয়। কেমিক্যাল পণ্য হিসেবে অর্গানিক কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যালস, ফার্টিলাইজার, ডায়িং প্রভৃতি আমদানি হয়। এসব কেমিক্যাল চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প, টেক্সটাইল, রং, কসমেটিক্স, ওষুধ, সারকারখানা প্রভৃতিতে ব্যবহৃত হয়। যেসব পণ্য রপ্তানি হয় সেসব পণ্যের মধ্যে অনেক পণ্যে এসব কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত দশ বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রায় সবগুলোই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে অবহেলাজনিত কারণে হয়েছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল অনিরাপদ ও অবৈধ গোডাউনে কেমিক্যাল মজুতের কারণে। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কেমিক্যাল ব্যবসা করছেন। তারা কেমিক্যাল মজুত, পরিবহণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে আইনের বাধ্যবাধকতা মানছেন না।
আমদানি করা কন্টেইনার ভর্তি কেমিক্যাল চট্টগ্রাম বন্দরে নামানোর সময় তেমন কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কন্টেইনারগুলোর গায়ে কেমিক্যাল থাকার সতর্কতামূলক কোনো নির্দেশনা থাকে না। সাধারণ পণ্য, যন্ত্রপাতি, গার্মেন্টসের যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য বহনকরা কন্টেইনারের সঙ্গে কেমিক্যালের কন্টেইনার পরিবহণ করা হয়।
আবার কেমিক্যাল বহন করা কন্টেইনারগুলো ডিপোতে রাখার ক্ষেত্রে অন্য কন্টেইনার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হয় না।
সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের সময় দেখা গেছে, সব ধরনের পণ্যবাহী কন্টেইনার পাশাপাশি রাখা হয়েছে। কন্টেইনারগুলোতে ইংরেজিতে অতিদাহ্য বা বিস্ফোরকদ্রব্য বা বিপজ্জনক এমন ধরনের কোনো লেখা ছিল না। সেখানে একটি কন্টেইনারে আগুনের সূত্রপাত হয়। অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে গিয়ে পাশাপাশি রাখা কন্টেইনারগুলোতেও একই ধরনের সাধারণ পণ্য রয়েছে বলে তথ্য জানতে পারে। সেখানে যে রপ্তানিযোগ্য হাইড্রোজেন পারক্সাইডের কন্টেইনার রাখা ছিল, সেটা ফায়ার সার্ভিস জানতেই পারেনি।
সাধারণত কেমিক্যাল থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস ফোম ব্যবহার করে। আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করলে, সেই আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং অধিক তাপ উৎপন্ন হয়। তখন পাশে রাখা কেমিক্যালের পণ্য বিস্ফোরিত হয় যা অগ্নিকাণ্ড ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, বৈধ বা অবৈধ যে পথেই কেমিক্যাল আসুক না কেন, কোথায় মজুত করা হচ্ছে, কারা আনছে, কীভাবে পরিবহণ করা হচ্ছে, কী কাজে ব্যবহার করছে-সেটা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবগত হতে হবে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কেমিক্যাল খালাসের পর এর পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট শিল্প মন্ত্রণালয়কে সতর্ক হওয়া জরুরী। কারণ কেমিক্যালগুলো অনেকটা অনিরাপদ অবস্থায় পরিবহণ করা হয়। পরিবহণের একটি নীতিমালা থাকা উচিত। কেমিক্যালগুলো কীভাবে মজুত করা হচ্ছে- সে বিষয়েও নজরদারি থাকা জরুরি।
তিনি আরো বলেন, উন্নত দেশে কেমিক্যাল পরিবহণ করা গাড়িগুলোতে বিশেষ চিহ্ন বা সতর্কতামূলক বার্তা লেখা থাকে। আমাদের দেশে শুধু জ্বালানি তেল পরিবহণকারী ট্যাংকলরি শুধু লাল রঙের হয় এবং এর গায়ে সতর্কতামূলক বার্তা লেখা থাকে। এমনকি কেমিক্যাল বহন করা কন্টেইনার বা গাড়ির চালকরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। আমাদের দেশে এমন কোনো নীতিমালা নেই। কেমিক্যাল বহন করা কন্টেইনার বা গাড়িগুলো একটি নির্দিষ্ট রঙের হবে এবং এটাতে সতর্কতামূলক বার্তা লেখা থাকবে। যেটা যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে যে কন্টেইনার বা গাড়িতে বিপজ্জনক কেমিক্যাল রয়েছে।
মন্তব্য