-->
শিরোনাম

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও প্রশ্নবিদ্ধ

তরিকুল ইসলাম
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও প্রশ্নবিদ্ধ
ছবি: সংগৃহীত

চলতি মাসেই খুলতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার। প্রায় তিন বছর পর দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে খুললেও আবারো সিন্ডিকেট জটিলতায় প্রশ্নবিদ্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। দেশটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই কর্মী পাঠাতে যাচ্ছে সরকার। এর আগেও সিলেক্টেড ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়েছিল মালয়েশিয়া। সে সময় অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়সহ নানা অনিয়মের কারণে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল দেশটি।

# শূন্য অভিবাসন ব্যয় নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ

# ফেরেনি শৃঙ্খলা, আবারো বন্ধের শঙ্কা

মালয়েশিয়া একই প্রক্রিয়ায় ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে আবারো কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রাখায় এ খাতে শৃঙ্খলা না ফেরায় শ্রমবাজারটি আবারো বন্ধের আশঙ্কা করছেন শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শৃঙ্খলা ফেরাতে অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সুশাসনের প্রয়োজন। এজন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় অথবা সরকারের আরো উচ্চপর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মধ্যে যে বিভক্তি রয়েছ সেটিও দূর করে গণতান্ত্রিক ধারা বজায়ের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো কথিত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আরো বাড়বে।

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় আগের বাদ পরা ১০ এজেন্সির মধ্যে থেকে চার এজেন্সি এবারের ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায় রয়েছে। তালিকায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও বেনজির আহমদ ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সব রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মী পাঠাতে বাধা কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, মালয়েশিয়াকে আমরা আমাদের নিবন্ধিত ১ হাজার ৫২০টি, অর্থাৎ সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা দিয়েছি। এবার মালয়েশিয়াই তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের তরফে কোনো অস্বচ্ছতা আমরা রাখিনি বা রাখতে চাই না। এটা মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্ত। সমঝোতার আলোকেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

মালয়েশিয়া বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিলেও সেসব দেশের সঙ্গে করা চুক্তিতে রিক্রুটিং এজেন্সি নির্ধারণ করতে পারে না। কর্মী পাঠানো দেশগুলোই তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়। কেবল বাংলাদেশের বেলায় এমন চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে কোনো দেশের কি চুক্তি রয়েছে সেটা নিয়ে তো আমি বলতে পারব না। আমি আমাদের কথা বলতে পারব।

এ নিয়ে গত জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদকে জানান, কেবল নির্বাচিত ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি ও ২৫০টি সাব এজেন্টের মাধ্যমেই বাংলাদেশি কর্মীদের পাঠাতে হবে। এরপর ফিরতি চিঠিতে মন্ত্রী লেখেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বশেষ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মন্ত্রী তার অবস্থান থেকে সরে আসায় উদ্বিগ্ন শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা।

মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমরা একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছি। আশা করি, জুন মাসের মধ্যেই (চলতি মাস) আমরা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু করতে পারব। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম বছরেই দুই লাখ কর্মী যাওয়ার কথা। এ ছাড়া পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ কর্মী যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের (মালয়েশিয়ার) চাহিদা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী আশা করি পাঁচ লাখ কর্মী আমরা দ্রুত পাঠিয়ে দিতে পারব।

অভিবাসী কর্মীদের শূন্য খরচে দেশটিতে যাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বলেন, মেডিকেল, পাসপোর্ট ও করোনা টেস্টের খরচ কর্মী বহন করবেন। মালয়েশিয়ায় গিয়ে কোয়ারেন্টাইনের খরচও কর্মীকে বহন করতে হবে। কর্মীদের যাওয়া আসার বিমান খরচ বহন করবে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা। সম্ভাব্য ব্যয়টা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে আগের তুলনায় খরচ কম হবে। কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি যদি নিয়মের বাইরে যায়, সেক্ষেত্রে মালয়েশিয়া তারা তাদের মতো এবং আমরা আমাদের মতো ব্যবস্থা নেব।

অবশ্য এর আগে মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে শৃঙ্খলা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর গ্রুপিং বা সিন্ডিকেট ঠেকাতে আমরা সব সময়েই সজাগ থেকেছি। তবু দেখা যায়, এরা বিদেশে বসে সিন্ডিকেট করে। দেশে বসে সিন্ডিকেট করলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, কিন্তু বিদেশে বসে এমন কিছু হলে সেখানে আমাদের কিছুই করার থাকে না।

অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে জিটুজি প্লাসে কর্মী প্রতি সরকার নির্ধারিত ব্যয় প্রথমে ছিল ৩৭ হাজার টাকা। পরে তা হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আগে কর্মী প্রতি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা কাগজে কলমে ব্যয়ের হিসেব থাকলেও মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মীকে খরচ করতে হয়েছে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এবার সরকার নির্ধারিত ব্যয় আগের তুলনায় যতই কম হোক, মালয়েশিয়া যেতে গড়ে চার লাখ টাকাই ব্যয় করতে হবে একজন কর্মীকে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। এরপর ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর এক মাসের মধ্যে কর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও সিন্ডিকেট ইস্যুতে গত ছয় মাস ধরে তা ঝুলে ছিল। এরপর বৃহস্পতিবার (২ জুন) বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চলতি জুন মাস থেকেই কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছায় ওয়ার্কিং গ্রুপ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মীদের সর্বনিম্ন বেতন হবে ১ হাজার ৫০০ হাজার রিঙ্গিত।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক মাইগেশন প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মালয়েশিয়া এখন যদি ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লোক নিতে চায়, তাহলে আগে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লোক নেওয়া বন্ধ করল কেন? তাহলে নিশ্চয়ই তাদের আগের বন্ধ করাটা ঠিক নেই। আর বন্ধ করাটা যদি ঠিকই থাকে তাহলে এখন আবার ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লোক নেওয়াটা অন্যায়। যতবারই মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, প্রতিবারই একই সংকট তৈরি হয়েছে।

এক হাজার ৫২০টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে কোনো ধরনের স্ট্যান্ডার্ড ও মানের ভিত্তিতে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে নির্ধারণ করা হলো এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সদ্য নিবন্ধন পাওয়া রিক্রুটিং এজেন্সি যাদের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তারাও ২৫টির তালিকায় রয়েছে। অভিজ্ঞদের কোনো কারণে বাদ দিয়ে তাদের কিসের ভিত্তিতে রাখা হলো? টাকা পয়সা লেনদেন, ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতি এমন অভিযোগ না থাকলে এই সিদ্ধান্তটা অস্বচ্ছতার প্রমাণ করে।

মালয়েশিয়ায় সুনির্দ্দিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের বিষয়টি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশেরই আইন সম্মত নয় উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, সাধারণত মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে কোনোভাবে কখনোই আইনি বিষয়গুলো মেন্টেইন করা হয়নি। এ কারণে মালয়েশিয়ারও অনেক প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে আছে এবং বিদেশ থেকেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। আইএলও’র কনভেনশন ও প্রতিযোগিতা আইনের বিষয়টি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে মালয়েশিয়াকে জানানো হলেও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটুট রয়েছে। এর ফলে যে কথিত যে সিন্ডিকেটের কথা শোনা যাচ্ছে, তারাই একচেটিয়া ব্যবসা করে যাবে।

কর্মীরা কত টাকা খরচ করে যাবেন, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, প্রতারণার শিকার হওয়া দিকগুলোসহ নিয়োগ কর্তার ব্যয় বহনের বিষয়গুলোতে মন্ত্রণালয়ের স্বচ্ছ ও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। যেহেতু এবার আবারো অল্পকিছু রিক্রুটিং এজেন্সি সিলেক্ট হয়েছে। এ কারণে তারা অনেক বেশি খরচ নেবে। যেটা অতিতে হয়েছে। অনেকে ব্যবসা করবে এবং আগের সংকটগুলোই দেখা দেবে।

মালয়েশিয়ায় শূন্য ব্যয়ে কর্মী পাঠনো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিয়োগ কর্তাই যদি বিমান খরচসহ সব খরচ বহন করে তবে, একজন কর্মীকে তো তার পাসপোর্ট, বিএমইটি ও অন্যান্য সব খরচ ৩০ থেকে ৪০ হাজারের বেশি হওয়ার কথা না। সরকার কতটাকা নির্ধারণ করে সেটাই দেখার অপেক্ষা। যেমন সৌদি আরবে নারী কর্মীরা কোনো খরচ ছাড়াই যেতে পারছেন, কর্মীকে যদি খরচ বহন করতেই হয় তবে সেটাকে তো শূন্য ব্যয় বলা যায় না।

বায়রার সাবেক মহসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, মালয়েশিয়া যে কারণে আগে বন্ধ করেছিল ঠিক একইভাবে আবার লোক নিতে চাচ্ছে। কর্মীর বেতন ও অন্যান্য ইস্যুতে ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ রেখেছে এবং সর্বশেষ তারা গত মাসে মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করেছে। প্ল্যান্টেশন ও কনস্ট্রাকশন খাতে লোক পাঠানো বন্ধ রেখেছে ইন্দোনোশিয়া। নেপালও পাঠাচ্ছে না। এই দুটি খাতে কোনো দেশই লোক পাঠাতে চাচ্ছে না। এই খাতে মালয়েশিয়ার প্রতিদিন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তিন থেকে চার লাখ লোক এই খাতেই লাগবে। বাংলাদেশই তাদের ভরসা। এ কারণেই এবার বাংলাদেশের সুযোগ ছিল মালয়েশিয়ার সঙ্গে যৌক্তিক আলোচনা করে বাজারটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা। মালয়েশিয়ার প্রেসক্রিপশেন অনুযায়ী নয়, কর্মীর স্বার্থ রক্ষা করেই পাঠানো উচিত।

এর আগে চরম দুর্নীতি, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়সহ নানান অভিযোগের কারণে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছিল। তারাই আবার এখন একইভাবে শ্রমবাজারটি চালু করেছে। ২০১৬ ও ১৮ সালে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল, আবার তা ঘটবে না এর নিশ্চয়তা নিয়েও শঙ্কিত বায়রার সাবেক এ মহাসচিব।

তিনি বলেন, এর আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছিলেন অনিয়মের অভিযোগ পেলে লাইসেন্স বাতিল করে দেবেন। মালয়েশিয়া যখন নানান অভিযোগে ১০ এজন্সির কর্মী পাঠানো বন্ধ করল, তখন কিন্তু তাদের লাইসেন্স বাতিলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আবরো তারা যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন, সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, পূর্বে এমন কিছু আমরা দেখিনি।

এর আগে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কারণে মালয়েশিয়ার ২৭টি প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক লিস্টেড করেছিলো আন্তর্জাতিক কমিউনিটি। তখন তাদের তৈরি প্রোডাক্ট ইউরোপের বায়াররা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের পদক্ষেপের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যেক কর্মীকে ১৫ থেকে ২০ হাজার রিঙ্গিত ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল।

মালয়েশিয়ার এখন ৫ থেকে ৬ লাখ কর্মীর প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী দুই বছরের আগে ২৫টি এজেন্সির মাধ্যমে কোনোভাবেই এতো সংখ্যক কর্মী পাঠানো সম্ভব না। কারণ এত কম সময়ে এত লোক পাঠানোর সক্ষমতারও বিষয় আছে। যদিও পাঠানো যায়, সেক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশনসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে। সব রিক্রুটিং এজেন্সি লোক পাঠাতে পারলে সবাই মিলে হয়তো এতো লোক ছয় মাসের মধ্যেই পাঠানো সম্ভব ছিল।

দুই বছরে যে কর্মী যাওয়ার কথা সে যদি পাঁচ মাসের মধ্যে যেতে পারে তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরো এগিয়ে যেত। সবাই মিলে কাজ করার সুযোগ পেলে এতে উভয় দেশই লাভবান হতো।

নোমান বলেন, সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি ২০০৮ সাল থেকেই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদেরকে ১৪ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এরপর ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জিটুজি প্রক্রিয়ায় কর্মী নেওয়া হয়। তিন বছরে তখন জিটুজির মাধ্যমে মাত্র ৯ হাজার কর্মী গেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠনো হয়। সে সময় প্রায় দুই লাখ ৭৫ হাজার কর্মী যায়। এরপর কর্মীর অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়সহ নানান অভিযোগে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি। ২০২২ সালে এসে ১০ এজেন্সির জায়গায় ২৫ এজেন্সিকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে আবারো সেই একই পথে হাঁটল মালয়েশিয়ার নীতিনির্ধারকরা।

তিনি বলেন, ৯৮ শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সিকে গত ১৪ বছরের কাজের সুযোগই দেওয়া হলো না। প্রতি দুই বছর পর পর লাইসেন্স নবায়নের সময় এজেন্সির প্রোফাইল জমা দিতে হয়। সেখানে যখন দেখবে প্রতিষ্ঠানটি কোনো কাজ করতে পারেনি, তখন লাইসেন্স ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে যাবে। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ দেখাতে হবে। মার্কেটেই কাজের সুযোগ দেওয়া হলো না এবং কাজ না দেখানোয় বেশিরভাগ লাইসেন্স নবায়ন হবে না। ২০১৩ সালের আইনে দক্ষতা অনুযায়ী ক্লাসিফিকেশন করার কথা। ৯৮ ভাগ এজেন্সি তো কাজই করতে পারলো না। ২০০৮ ও ২০১৬ সালে যে দুই বা এক শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করলো তারা তো ক্লাসিফিকেশনে বেশি নম্বর পেয়ে এগিয়ে যাবে। এজেন্সিগুলোকে এবার সিআইপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানেও তারা এগিয়ে যাবেন। তারাই শেষ পর্যন্ত সিআইপি হবেন।

এথিক্যাল, ফেয়ার ও ট্রান্সপারেন্ট রিক্রুটমেন্টের কথা বলা হলেও সেটি এখানে কোনোভাবেই কাজ করছে না। সৌদি আরব ও দুবাইয়ের পরেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজরের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ সেখানে মাল্টি লেয়ারে কর্মীরা কাজের সুযোগ পান। থাকা-খাওয়া বেতন ও পরিবেশও বেশ ভালো। নিয়োগ কর্তারাও বাংলাদেশি কর্মীদের নির্ভরশীল এবং তাদের পছন্দ করেন। মন্ত্রণালয় যে কথাগুলো বলে তার বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষাই আমাদের করতে হবে। তবে আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এমন বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়নি।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, সিলেক্টিভ রিক্রুটিং এজেন্সির বাইরেও একটি পক্ষ রয়েছে। যাদের মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তারা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার থেকে লাভবান হয় এবং দেশটির ব্যবসা ও রাজনৈতিক ফর্মে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। এখান থেকে ভালোকিছু আশা করাটা একটু কঠিন। আইনের মাধ্যমে তো সমাধান দেখছি না। এই ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের মধ্যে যদি সুশাসনের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়, সরকার সেটি ভেবে দেখতে পারে। বায়রার মধ্যে বিভাজন রয়েছে, এটাকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে এনে সচল করার উদ্যোগ নিতে হবে। সুযোগ সন্ধানীরা এই বিভক্তিকেও কাজে লাগাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকার যদি এজেন্সির কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্লাসিফিকেশন রুলটা চালু করতে পারে সে ক্ষেত্রে একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। যেমন শ্রীলঙ্কায় ক্লাসিফিকেশন সিস্টেমটা চালু আছে। সেখানে এজেন্সির কর্মকা-গুলো নজরদারিতে রেখে রেটিং দেওয়া হয়। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এই নিয়মটা চালু হলে সিন্ডিকেটের বিষয়টি তখন হয়তো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। নয়তো, যারা শক্তিধর ও বিত্তবান ব্যবসায়ী, তারাই এই সেক্টরটিকে কন্ট্রোল করবে।

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যখন লাইসেন্স দেওয়া হয় বা নবায়ন করা হয় তখন তাদের ব্যবসাটা সৎভাবে হচ্ছে কিনা সেটাও মনিটর করা উচিত। যারা এথিক্যাল প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে যান, তাদের অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যারা ভালোভাবে ব্যাবসা করছেন এক্ষেত্রে তাদের পুরস্কৃত করা যেতে পারে।

পাসপোর্ট কর্মীর আইডেন্টিটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাসপোর্ট কর্মী তার নিজস্ব ব্যয় করবে এর বাইরে অন্যান্য খরচ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে নিয়োগ কর্তা বহন করবে। আমাদের এখানে অভিবাসন প্রক্রিয়া এখনো অনেক খানি ম্যানুয়াল। সে ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখাটাও বেশ কঠিন। মাঠ পর্যায়ে দালালরাও এই সুযোগ নেয়। শূন্য অভিবাসন নিশ্চিত করাটা সরকারের জন্য বেশ কঠিন। ডিজিটাল ও অনলাইন সিস্টেম করা গেলে পুরোপুরি যে সচ্ছতা ফিরে আসবে বিষয়টি এমনও নয়। পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে আমরা ভেবেছিলাম দুর্নীতি কম হবে, কিন্তু দেখলাম তা কিন্তু হয়নি। এজন্য অবশ্যই দেশপ্রেম ও নীতি নৈতিকতারও দরকার আছে। যেটা আমাদের মাঝে নেই।

ইকুইডেম রিসার্চ অ্যান্ড কন্সালটিং এর বাংলাদেশ বিষয়ক গবেষক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন বলেন, যেভাবে শ্রমবাজারটি খুলেছে, এতে একটা পক্ষ লাভবান হবে। সার্বিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। আনসারর্টেন বেইজের ওপরে একটি কনক্রিট ব্যবসাকে দাঁড় করালে যেটা হয়, সেটা হলো ব্যবসাটা বেশিদিন টিকে না এবং সেটি হারাতে হয়। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এতদিন পর ফিরে পাওয়াটা একটি বড় অর্জন। সিন্ডিকেটের জালের ভেতরে আটকে এটা যাতে আবার নষ্ট না হয় এজন্য সরকারকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজর সম্পর্কে অবশ্যই যত্মশীল হতে হবে।

মন্তব্য

Beta version