-->
শিরোনাম

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি: প্রাণহানির নেপথ্যে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম

রুদ্র মিজান
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি: প্রাণহানির নেপথ্যে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম
ফাইল ছবি

অন্যের জীবন বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৯ যোদ্ধা। খোঁজ মিলেনি আরো তিনজনের। ফায়ার সার্ভিসের ইতিহাসে এত ফায়ার ফাইটারের প্রাণ ঝরেনি কখনো। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪ জন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের এই আত্মত্যাগ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এজন্য অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মই দায়ী।

প্রভাব খাটিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বিএম কন্টেইনার ডিপো গড়ে তোলা ও এতে যেনতেনভাবে দাহ্য পদার্থ মজুত করা ছিল। আগুন লাগার এই সত্য ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের অবগত করেনি কেউ। কর্তৃপক্ষকে পাওয়া যায়নি সেখানে। বরং কেউ কেউ ভুল তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, ডিপোতে রয়েছে গার্মেন্টস পণ্য।

একজন ফায়ার বিশেষজ্ঞ জানান, উন্নত কোনো দেশে কখনোই এভাবে আগুন নেভাতে যেত না ফায়ার কর্মীরা। তারা শুরুতে বুঝতে চেষ্টা করত কিসের আগুন। নিশ্চিত হয়ে তবেই যথাযথ পদ্ধতিতে অগ্নিনির্বাপণের কাজ শুরু করত। দাহ্য পদার্থের বিষয়টি নিশ্চিত হলে প্রথমেই আশপাশের লোকজনকে সরানোর ব্যবস্থা করা হতো। তারপর শুরু হতো অগ্নিনির্বাপণের কাজ। রাসায়নিক থেকে সৃষ্ট আগুন নেভাতে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করে পদ্ধতি বের করা হয়। প্রাথমিকভাবে সিওটু বা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস ও কুয়াশার মতো পানি দিয়ে অগ্নিনির্বাপণ করা হয়। সিওটু দ্বারা অগ্নিনির্বাপণ করা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। সিওটু বা কার্বন ডাই অক্সাইড দেওয়ার পর অক্সিজেন সরে আগুন নিভে যায়।

তবে রাসায়নিকের আগুন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নেভাতে হয়। রাসায়নিক বিভিন্ন ধরনের হয়। তা পানির সঙ্গে বিক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। অনেক রাসায়নিক পানির বিক্রিয়ায় বিস্ফোরকে পরিণত হয়। কোনো কোনো রাসায়নিক তাপে দ্রুত ছড়ায়। যে কারণে শুরুতে পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

রাসায়নিক পদার্থ মজুত রাখার ক্ষেত্রে ডিপোর ভেতরে নিজস্ব স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার নিয়ম রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, ডিপোতে যেমন রাসায়নিক পদার্থ রাখার নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে তেমনি কোন ধরনের পদার্থ, এতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কিভাবে নির্বাপণ করতে হবে, এটি বাতাসে মিশলে কী হতে পারে এসব বিষয়ে ডিপোর বাইরে বড় আকারে লেখা থাকার নিয়ম রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আমাদের দেশে আগুন লাগার পর ৯৯৯ বা জরুরি নম্বরে কল দিয়ে স্থানের নাম উল্লেখ করে জানানো হয় সেখানে আগুন লেগেছে। এই তথ্য পেয়েই আগুন নেভাতে দ্রুত ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। যেমনটি হয়েছে সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে। দ্রুত সেখানে পৌঁছে আগুন নেভাতে গেলে মারা যান ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মী।

এখনো খোঁজ মিলেনি আরো তিনজনের। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, আগুন নেভানোর কাজ শুরু করার পর সেখানে কেমিক্যাল বিস্ফোরণ ঘটে। তখন পর্যন্ত জানা যায়নি ডিপোতে কি ধরনের পদার্থ রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ১২ ঘণ্টা পরও দেখা মিলেনি মালিকপক্ষের। শুরুতে ভুল তথ্য দেন আশপাশের লোকজন। তারা জানান, গার্মেন্টস পণ্য রয়েছে ডিপোতে।

সূত্রে জানা গেছে, বিপজ্জনক উপদানের সৃষ্ট আগুন নেভানোর বিষয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফায়ার কর্মী রয়েছেন প্রায় ১৫০ জন। হ্যাজমেট টিমের সদস্যও সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। কেউ বদলি হয়ে ময়মনসিংহে, কেউ রাজশাহীতে, কেউ চট্টগ্রামে, কেউ ঢাকায়। এই টিমকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়নি। তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, সঠিক তথ্য পেলে হ্যাজমেট টিমের সদস্যদের সেখানো পাঠানো সম্ভব হতো।

ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্যানুসারে, ১৯৮২ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গঠনের পর আগুন নেভাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এর মধ্যে ৯ জনই মারা গেছে গত ৪ জুন সীতাকু-ের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়।

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মো. রানা মিয়া, মনিরুজ্জামান, আলাউদ্দিন, মো. ইমরান হোসেন মজুমদার, মো. শাকিল তরফদার, মিঠু দেওয়ান, রমজানুল ইসলাম, নিপন চাকমা ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।

সীতাকুণ্ডের আগুন নিভাতে গিয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন শফিউল ইসলাম, ফরিদুজ্জামান ও রবিউল ইসলাম। ১৯৮৯ সালে অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়ে নিহত হন ফায়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান, ১৯৯১ সালে মো. মুসলিম উদ্দিন, ২০০১ সালে মো. জহিরুল হামিদ ও মো. মাহাবুবুর হোসেন খান, ২০০৬ সালে আক্তার হোসেন, ২০০৮ সালে অমল চন্দ্র মণ্ডল, ফায়ার লিডার আব্দুর রশিদ ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক আজিজ হাওলাদার, ২০০৯ সালে শেখ জালাল, ২০১৫ সালে ফায়ারম্যান মো. শাহ আলম, ২০১৩ সালে আবু সাইদ, ২০১৭ সালে আব্দুল মতিন, ২০১৯ সালে মো. সোহেল রানা, ২০২১ সালে ডুবুরি আব্দুল মতিন এবং ২০২১ সালে মো. মিলন মিয়া, আবুল কালাম আজাদ ও ফায়ারম্যান নির্গেন্দু প্রসন্ন সিংহ।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, ডিপোর মালিক বা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ফায়ার ফাইটারদের সঠিক তথ্য দেওয়া। তাদের এলাকায় কোথাও কোনো ঝুঁঁকিপূর্ণ কিছু আছে কি না। বিষয়টি জানা থাকলে এত ফায়ার ফাইটারদের জীবন দিতে হতো না। সীতাকু-ের ঘটনায় এসব তথ্য আদান-প্রদানে সমন্বয়হীনতা ছিল বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়াও আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসকে আরো আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। এজন্য উন্নতমানের ইকুইপমেন্ট ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, সীতাকু-ের ওই ডিপোতে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা ছিল না। তাদের হাইড্রেন্ট সিস্টেম মোটেই ছিল না। এছাড়াও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা ছিল না। ১০ কানি জমির ওপর একটা ডিপো। কিন্তু নাজুক অবস্থা। ভেতরে একটি সাব স্টেশনস ছিল এবং একটি পেট্রোল ডিপো ছিল, এতে আগুন লাগেনি। লাগলে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করত।

ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার জানান, করোনার প্রকোপের আগে গত বছরে ফায়ার সার্ভিসের বিপুল কর্মীকে বিপজ্জনক উপাদানের সৃষ্ট আগুন নেভানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে তারা প্রশিক্ষণ নেন। করোনার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও এই প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেশের বিভিন্ন নগরে ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করছেন।

 

মন্তব্য

Beta version