-->
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস আজ

অসহনীয় যন্ত্রণা সয়ে কাজ করে শিশুরা

নিখিল মানখিন






অসহনীয় যন্ত্রণা সয়ে কাজ করে শিশুরা
ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডে একটি কার সার্ভিসে কাজ করে ১২ বছরের শিশু মো. বেলাল। মেরামত করাতে আসা কোনো গাড়ির ড্রাইভারকে ডাক দিয়ে সার্ভিস সেন্টারে টেনে নিয়ে যাওয়াই তার কাজ। নিজের দোকানে গাড়ির ড্রাইভারকে টেনে নিতে তাকে পাশের দোকানগুলোর একই পেশায় নিয়োজিত শিশুদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। মাঝেমধ্যে খেতে হয় চড়-থাপ্পড়।

সারাদিনে তাকে দেয়া হয় দুবেলা ভাত। মাস শেষে ধরিয়ে দেয়া হয় নামমাত্র কিছু টাকা। দেশে তার মতো লাখ লাখ শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের জীবনের নেই নিরাপত্তা। এমন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি অপ্রকাশিত রয়ে যায়। অন্তরে জমে পাহাড়সম কষ্ট ও যন্ত্রণা। সব সহ্য করে বেঁচে থাকার আশায় প্রতিকূল পরিবেশে শ্রম বিক্রি করে চলে শিশুরা।

- ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে

-অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে তারা শ্রমে নিয়োজিত

-তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে কাজের ক্ষেত্র

-শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্য থাকলেও বৈশ্বিক এ উন্নয়ন দলিল প্রণয়নের ছয় বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে দেশে শিশুশ্রমের কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। সংস্থার ২০১৩ সালে পরিচালিত সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে ৩ কোটি ৯৬ লাখ শিশুর ৯ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ, ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনো শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে, ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সি এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম বন্ধে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে জোরালোভাবে তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করতে হবে। জাতীয় শিশুনীতিতে এটা স্বীকার করা হয় যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের ভেদ নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে শিশুশ্রমের করুণ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। নগরীর উত্তর বাড্ডা গোপীবাগ এলাকায় ‘বেলা রেস্টুরেন্ট’ এ কাজ করে ১৪ বছরের শিশু মো. ফারুক। মা খালেদা অন্যের বাসায় কাজ করেন এবং বাবা ঠেলাগাড়িতে করে সবজি বিক্রি করেন। আর্থিক সংকটে পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতেই তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর ফার্মগেটের তেজতুরি বাজার এলাকার বাবুল রেস্টুরেন্টে থালাবাসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত ১০ বছরের শিশু মো. হাবিব। সকালে নাশতা বানানোর কাজে সহায়তা করা থেকে শুরু করে বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু দেয়া, বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে সে প্রতিদিন।

টাঙ্গাইল থেকে আসা ১৪ বছর বয়সি এই শিশুটি জানায়, ৪ ভাইবোনের সংসারে সে দ্বিতীয় সন্তান। দরিদ্র বাবা-মায়ের কষ্ট একটু ঘোচাতে ৫ বছর আগে সে ঢাকায় আসে। রেস্টুরেন্টে আর বেশিদিন কাজ করা যাবে না বলে জানায় মো. হাবিব। নেত্রকোনার ১৩ বছরের শিশু মাসুম মগবাজার পেয়ারাবাগ কাঁচাবাজারের পাশের একটি চা দোকানে কাজ করে। তার মালিক কাশেম চা তৈরি করেন।

আর লোকজনের হাতে চা তুলে দেয় মাসুম। আশপাশের দোকানে দোকানে গিয়েও তাকে চা দিয়ে আসতে হয়। শিশু মাসুম জানায়, মা রাহেলা বেগম অন্যের বাসায় কাজ করেন। বাবা সবুজ মিয়া রিক্সা চালান। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। অসচ্ছলতার কারণেই সে লেখাপড়া করতে পারছে বলে জানায় শিশু মাসুম।

শিশুটির নাম হাবিব, জন্মের কিছুদিন পরই দিনমজুর বাবাকে হারিয়েছে। ওই পরিবারে নেমে আসে কালো ছায়া। বাঁচার তাগিদে শিশু থেকেই কাজে নেমেছে সে। এখন তার বয়স ১৪ বছর। যে বয়সে তার স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছোটাছুটি করার কথা, তখন সে মগবাজার রেলগেটের একটি ওয়ার্কশপের ঝালাইসহ রড-টিন কাটা ও হাতুড়ি পেটানোর মতো অধিক ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজ করছে।

শুধু শিশু হাবিব নয়, ১১ বছরের ইকবাল চালায় রিকশা, ৯ বছরের জাফর করছে খাবার হোটেলের কাজ। ১০ বছরের শিশু জয়নাল পরিত্যক্ত শাক-সবজি, ফলমূল কুড়ায় কারওয়ানবাজারে। এসব কুড়িয়ে সে তার মায়ের কাছে জমা দেয়। আর তার মা সেগুলো পরিষ্কার করে বাজারের এক পাশে ভাগা সাজিয়ে বিক্রি করে।

এসব কুড়াতে গিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বলে জানায় শিশু জয়নাল। পুরান ঢাকার ট্যানারি কারখানাগুলোতে শিশুরা ভয়াবহ পরিবেশে কাজ করছে। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কয়েকটি লোহার কারখানায় দেখা গেছে, শিশুদের দিয়ে ভারী লেদ মেশিনে কাজ করানো হচ্ছে। কর্মঘণ্টা এবং দৈনিক কর্মতালিকার কোনো বালাই নেই সেখানে। সপ্তাহে একদিন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও চাকরিচ্যুত করার আগে কোনো নোটিশ দেয়া হয় না।

এছাড়া কর্মস্থলে তারা বড়দের দ্বারা নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এভাবে সারাদেশে এ রকম শত শত শিশু এখন জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার তাগিদে দৈনিক ৫০-১০০ টাকা আয়ে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছে। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বাবা-মা শিশুকে সামান্য টাকার বিনিময়েই এসব কাজে লাগিয়ে দিচ্ছেন।

আর মালিক পক্ষও অনুকরণপ্রিয় শিশুদের কম টাকায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সুযোগ লুফে নিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন ফর চিলড্রেনে (১৯৯৭-২০০২) দেশে শিশুশ্রমের বিষয়টি প্রথম চিহ্নিত হয়। ২০০১ সালের মার্চ মাসে সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮২ নম্বর ধারায় অনুসমর্থন দেয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সে বছরই জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন শুরু করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তি-সংক্রান্ত বিশেষ বিধান রয়েছে।

শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারে, কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স হচ্ছে ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে হালকা কাজ করলে সেটাকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না।

৫ থেকে ১১ বছর বয়সি কোনো শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্র হিসেবে স্বীকৃত।

গত ৯ জুন একটি অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী সাংবাদিকদের বলেন, দেশের সকল সেক্টর থেকে শিশুশ্রম মুক্ত করতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে সরকার। তবে এ বিষয়ে বৈশ্বিক সহায়তা ও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ সংবিধানে জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইনের ধারা ৩৪-এ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফ) মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। শিশুশ্রম নির্মূল সংক্রান্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিসেফের সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। কর্মজীবী শিশুদের প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় শিশুশ্রম নির্মূল নীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে এই নীতি হালনাগাদের কাজ চলমান রয়েছে।

জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে শিশুশ্রমের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে শিশুশ্রম। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যে যোগ্যতা লাগে সেখানে শিশুশ্রম থাকতে পারে না।

শ্রেণিবৈষম্য অনেক বেড়েছে বলেই শিশুশ্রমও বেড়েছে। আমি মনে করি সরকার ও যেসব এনজিও শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সমন্বয় করে কাজ করলে আমরা ভালো কিছু করতে পারব।

মন্তব্য

Beta version