-->

‘খানি লাগতো নায় আগে জাগা দেউক্কা’

রুদ্র মিজান
‘খানি লাগতো নায় আগে জাগা দেউক্কা’

‘খানি পরে। অনে খানি লাগতো নায় আগে জাগা (জায়গা) দেউক্কা (দেন)। থাকার জাগা নাই। ঘরর ভেতরে কোমড়অইমা পানি। বাচ্চাইনতেরে রাখতাম কই কওকা।’ এভাবেই নিজের অবস্থান জানান দেন সুনামগঞ্জের দিরাই পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসনের স্ত্রী মনোয়ারা। পৌর শহরের এই এলাকা গত শুক্রবার রাতেই গেছে পানির নিচে। গত শনিবারও সেখানে প্রায় কোমর সমান পানি হয়েছে।

রোববারও অবস্থার উন্নতি হয়নি। পানিতে ভেসে গেছে ঘরের আসবাবপত্র। মনোয়ারা কাঁদছিলেন আর কথা বলছিলেন। তার কথা শেষ না হতেই মোবাইলফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই নেটওয়ার্ক থাকে না বন্যাদুর্গত ওই এলাকায়। ভারতের আসাম থেকে আসা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে সিলেট সদর থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জের প্রতিটি উপজেলা। সড়ক থেকে বাসাবাড়ি সর্বত্রই পানি আর পানি। বন্যার পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বন্যার্তদের চোখের জল। দিনভর বৃষ্টিতে বাড়ছে পানি। এতে একাকার হচ্ছে মানুষের হাহাকার।

হঠাৎ বনায় দোয়ারাবাজার থানার মান্নারগাঁওয়ে শুক্রবারই ডুবে যায় লেবু মিয়ার ঘর। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে টিনের চালে রেখে নৌকার খোঁজে বের হন লেবু মিয়া। কোথাও নৌকা মিলছে না। সুনামগঞ্জ সদরে বৃহস্পতিবার থেকেই পানি। মোবাইলনেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় একে-অন্যের কোনো খোঁজও নিতে পারছেন না।

ছাতকের বাসিন্দা আনহার আলম জানান, বন্যায় মানুষের জান বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনোভাবে বেঁচে আছেন। গত দুদিন ধরে ভাত খাননি। দোকান থেকে বিস্কিট, পাউরুটি কিনে খেয়েছেন। এখন দোকানগুলোও বন্ধ। পানি উঠে গেছে। নিরুপায় হয়ে ঘরে থাকা দুটি গরুকে ছেড়ে দিয়েছেন। কোথাও কোনো আশ্রয় পাচ্ছেন না। স্থানীয় স্কুলেও পানি উঠেছে।

একই অবস্থা দিরাই উপজেলার। দিরাই থানা, দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দিরাইয়ের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। আশ্রয় সঙ্কটে মানুষ। দিরাই কলেজ রোডস্থ এক দুতলা মার্কেটে বিপুল মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। গাদাগাদি করে থাকছেন তারা। কোনো কোনো গ্রামের মানুষ খাটের ওপরে, টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছেন। সবাই তাকিয়ে সরকারি সহযোগিতার দিকে। এই সময়ে বেশি প্রয়োজন নৌকার। দেখা দিয়েছে খাদ্যের অভাব।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানি গাঁওয়ের রশিদ মিয়া জানান, ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে গত শুক্রবারেই। ওই গ্রামেই আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেও উঠেছে পানি। রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। শুকনো খাবার খাচ্ছেন। বাচ্চারা খাবারের জন্য কান্না করছে। শুকনো খাবারও পাওয়া যাচ্ছে না এখন।

সুনামগঞ্জের বাসিন্দা মুমিত জানান, সুনামগঞ্জ সদরের এক ইঞ্চি মাটি নেই যেখানে পানি উঠেনি। শহরে যে সড়কে গাড়ি চলাচল করতো সেখানে এখানে সাঁতার কাটতে হচ্ছে। এমন ভয়াবহ বন্যা গত ৩০ বছরে দেখেনি সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে পুরো সুনামগঞ্জ জেলার মানুষ।

সিলেটের বিশ্বনাথের সাহেদ আহমেদ জানান, বিশুদ্ধ পানি সংকট রয়েছে। খাবার না পেয়ে পানি পান করবেন সেই সুযোগ কম। টিউবয়েলগুলো বন্যার পানিতে ডুবেছে।

সুনামগঞ্জের দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন শত শত মানুষ। সেখানে খাবার সংকট। দোকান বন্ধ থাকায় শুকনো খাবারও জুটছে না। তবে দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুরের লাখ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়ে ঘরহীন অবস্থায় আছেন। তারা আশ্রয় চাচ্ছেন। ফোন যোগাযোগ বন্ধ তারপরও নানাভাবে জেলা প্রশাসকের কাছে সহযোগিতার জন্য বার্তা পৌঁছাচ্ছেন তারা। সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভর উপজেলার মুক্তিখলা গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এই তথ্য জানিয়ে তাদের উদ্ধার করার আকুতি জানিয়েছেন নুর আহমদ নামে ওই গ্রামে এক বাসিন্দা।

তিনি জানান, প্রতিটি ঘরে পানি। গবাদি পশুগুলো প্রাণে মারা যাচ্ছে। মানুষ আশ্রয় খুঁজছে। খাদ্য খুঁজছে। ঘরে থাকা ধান পানিতে ভেসে যাচ্ছে।

মন্তব্য

Beta version