বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের চোখ খুলে দিয়েছে। এখন আর কেউ বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এর ফলে বিশ^ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে আগামীতে কোনোরকম সন্দেহ ছাড়াই আস্থার সঙ্গে তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীন, রাশিয়া, কোরিয়া, সৌদি আরব ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে গিয়ে তারা এই পদক্ষেপকে ‘চূড়ান্ত সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সাহস’ বলে উল্লেখ করেছেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টসহ ৭৫ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিদেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে পদ্মা সেতুর একের পর এক প্রতিবেদন। এমনকি বাদ যায়নি পাকিস্তানের গণমাধ্যমও।
প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপের প্রশংসায় চীনবাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস এবং তার দৃঢ় রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের প্রশংসা করেছে চীন। সেই সঙ্গে দেশটি বলেছে, এর ফলে বাংলাদেশে আগামীতে বিশ্বব্যাংক সন্দেহ ছাড়াই আস্থা নিয়ে তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, চাপ ও অভিযোগের মুখেও পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাহস, সংকল্প ও সমৃদ্ধির পথে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে গেছেন। যা অন্য যেকোনো দেশের সাধারণ কোনো নেতার পক্ষে করা ছিল প্রায় অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী তার দৃঢ় রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন বলেই সেতুটি আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সুস্পষ্ট অবদান রেখেছেন। কেননা এর জন্য ‘চূড়ান্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সাহস’ থাকা প্রয়োজন। পদ্মা সেতু সংকল্পের প্রতীক এবং সেতুটি নির্মাণে প্রায় আট বছর সময় লেগেছে। পদ্মা নদীর অনন্য হাইড্রোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য সেতু নির্মাণে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশ যে তার সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এ বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। বাংলাদেশ যে তার নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে এ নিয়ে বিদেশি কিছু উন্নয়ন অংশীদার বিশ্বাসই করতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রকল্প থেকে ঋণদাতাদের দের সরে দাঁড়ানো ছিল কেবলই বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের প্রতি তাদের আস্থার অভাব।
রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনা কোম্পানিগুলো এ যাবৎ চীনের বাইরে যত সেতু তৈরি করেছে পদ্মা সেতু ছিল সবচেয়ে বড় সেতু নির্মাণ। এটি নির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের পক্ষেও ছিল চ্যালেঞ্জ ও সাহসী পদক্ষেপ। চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের ওপর চীনের ভরসা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে কেউ কেউ খুশি নাও হতে পারে, তবে চীনের জনগণ খুশি। বাংলাদেশ যদি নিজস্ব অর্থায়নে কিছু করতে চায়, সেটি করার সক্ষমতা বাংলাদেশ রাখে। পদ্মা সেতু দুই পাড়ের মানুষকে এক সঙ্গে আবদ্ধ করে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ ছাড়া ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের মিসিং লিংক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু সমৃদ্ধির প্রতীক এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় যে, সেতুটি একবার যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এক দশমিক পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দেশের আনুমানিক ৮০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই সেতুটি থেকে উপকৃত হবেন। প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ স্থানীয় শ্রমিক দক্ষ শ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর বিশেষ ভূমিকার মূল্যায়ন ভারতেরবিবিআইএন এ কানেক্টিভিটিতে পদ্মা সেতুর বিশেষ ভূমিকার মূল্যায়ন ভারতের। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান- বিবিআইএন কানেক্টিভিটিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতে এই সেতু যে ভূমিকা রাখবে, এতে ভারত খুশি। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই আনন্দময় মুহূর্তে আমি বাংলাদেশকে অভিন্দন জানাই। বাংলাদেশের প্রতিটি বন্ধুকে আমি স্বাগত জানাই। এদিকে নয়দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সপ্তম যৌথ পরার্মশক বৈঠকে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে দেশটি।
পদ্মা সেতুকে গেম চেঞ্জার বলছে রাশিয়াপদ্মা সেতুকে ‘প্রকৃত গেম চেঞ্জার’ বলে অবহিত করেছে ঢাকায় রাশিয়ান দূতাবাস। কেননা সেতুটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ, কর্মসংস্থান, পর্যটন ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে বহুমুখী সুযোগ দেবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ একটি ‘মাইলফলক অর্জন’ এবং এটি বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে সম্ভব হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অনেকাংশে অবদান রাখবে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়নে সুবিধা দেবে। নিঃসন্দেহে রুশ কোম্পানি রোসাটমের সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশের সফল উন্নয়নের গল্প এবং জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণে আরো অবদান রাখবে।
বহুমুখী পদ্মা সেতুর আসন্ন উদ্বোধনে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছে রাশিয়ান দূতাবাস।
পদ্মায় দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে আগ্রহী জাপানপদ্মায় দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে আগ্রহী জাপান। পদ্মায় যদি আরেকটি সেতু নির্মাণ হয় তবে সেটিই হবে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বাস্তবতা। তাই জাপান চায় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশী দারিত্বের সুযোগ চায়। বাংলাদেশ এক সময় যে পদ্মায় দ্বিতীয় সেতু করবে সেটিই প্রকৃত বাস্তবতা উল্লেখ করে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন, জাপান সরকার ও জাইকা এই সরকারের নির্মাণ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বিবেচনার অবস্থানে থাকবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে এবং এর বাস্তবতার সুফল সবাই ভোগ করবে। পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় একটি চমৎকার মাইলফলক। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য কি করতে পারে এটি তার বড় প্রমাণ। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ও আকাক্সক্ষা পূরণ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করায় বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জানান জাপানের রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, এ মাসে পদ্মা সেতু এবং এ বছরের শেষ নাগাদ মেট্রো রেলসহ বিভিন্ন মানসম্মত অবকাঠামো উদ্বোধনের নজির সৃষ্টির মাধ্যমে ২০২২ সাল বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালে জাপান সফরের কথা স্মরণ করে বলেন, সে সময় তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) পদ্মা সেতু ও রূপসা সেতুতে সহযোগিতার জন্য জাপানের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। পরে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি পদ্মা ও রূপসা সেতুর প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করে। জাপান সরকারের আগ্রহ থাকার পরেও জাইকা পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সুযোগ পায়নি। তবে, সেতুর সম্ভব্যতা যাচাইয়ে যে অং গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল এজন্য জাপান গর্ববোধ করে। বাংলাদেশে মানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা থাকলে জাপান ভাল প্রযুক্তি দিতে প্রস্তুত রয়েছে। জাপান এ পর্যন্ত সারা দেশে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ১৩৪টি সেতু নির্মাণে সহযোগিতা করেছে।
বিনিয়োগকারীদের চোখ খুলে দেবে: সৌদি আরবঢাকায় নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত এসা ইউসুফ এসা আল দুহাইলান বলেছেন, বাংলাদেশকে বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে পদ্মা সেতু সৌদি কোম্পানিসহ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের চোখ খুলে দিতে সাহায্য করবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করি। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অর্জন যা জনগণের স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছে। বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত মেগা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ঐতিহাসিক দিনটি সামনে রেখে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার তথা বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সৌদি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে বিনিয়োগের গন্তব্য হিসাবে দেখছে এবং এ লক্ষ্যে শিগগিরই কিছু পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে। পদ্মা সেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি অনন্য প্রকল্প এবং এটি বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে চিন্তা করতে এবং আরো অবকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এটি বাংলাদেশকে উচ্চ অবস্থানে নিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার প্রমাণ করেছেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার দূরদর্শী ভাবনা দেশের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতিকে ট্র্যাকে রাখার জন্য তার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা অসাধারণ।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত: ইইউ রাষ্ট্রদূতপদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলি। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেশের উন্নয়নে এক ‘অবিস্মরণীয় মুহূর্ত’ হতে চলেছে। পদ্মা সেতু দেশের জিডিপিতে এক দশমিক দুই শতাংশের বেশি যোগ করবে।
পদ্মা সেতু ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’-এর অংশ নয়: বাংলাদেশপদ্মা সেতু চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের অংশ নয়। এই সেতু তৈরিতে বিদেশি সাহায্যও নেওয়া হয়নি। শুক্রবার (১৭ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, কিছু মহল পদ্মা সেতু বিদেশি অর্থায়নে তৈরি হয়েছে এবং এটাকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে চায় গোটা সেতুটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে তৈরি এবং কোনো দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সংস্থা এতে আর্থিক অবদান রাখেনি। দেশি-বিদেশি নির্মাণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
মন্তব্য