-->
ব্যবহার করা হয়েছে ৫০ দেশের উপকরণ

এক হাজার ২০০ প্রকৌশলী আর ২০ হাজার শ্রমিকের শ্রমে জেগে ওঠল পদ্মা

নিজস্ব প্রতিবেদক
এক হাজার ২০০ প্রকৌশলী আর ২০ হাজার শ্রমিকের শ্রমে জেগে ওঠল পদ্মা

পদ্মা সেতু শুধু নদীর দুই পাড়কেই যুক্ত করেনি, বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে অনেক দেশের সঙ্গে। সেতুতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী আর কর্মীর মেধার ব্যবহার হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে ভিনদেশি উপকরণ। যন্ত্রপাতি বিক্রি বা ভাড়া দিয়েছে অনেক দেশ। এভাবে অনেক দেশের মেধা আর উপকরণের মেলবন্ধনে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু।

 

পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক ও ভবনসহ নানা অবকাঠামো হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতু, নদীশাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজে কোন কোন দেশের উপকরণ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে, কোন কোন দেশের কর্মী কাজ করেছেন তার একটা হিসাব করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

এই প্রকল্পে বাংলাদেশসহ ২০টি দেশের মানুষ সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ১০টি দেশের বিপুল উপকরণ এবং প্রায় ৫০টি দেশের কিছু না কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মায় কাজ করেছে এক হাজার ২০০ প্রকৌশলী আর ২০ হাজার শ্রমিক।

যেসব দেশের মানুষ জড়িত

পদ্মা সেতুর বিশদ নকশা করা হয় হংকংয়ে। এতে নেতৃত্ব দেন ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। তিনি লম্বা স্প্যানের সেতুর নকশা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ সালে ব্রিটেনের রানি তাঁকে কমান্ডার অব দ্য অর্ডার পুরস্কারে ভূষিত করেন। নকশা প্রণয়নে ব্যবস্থাপক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কেন হুইটলার।

সেতুর নির্মাণকাজের তদারকির নেতৃত্ব দেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট জন এভস। আর নদীশাসনের নকশা প্রণয়নে ছিলেন কানাডার ব্রুস ওয়ালেস। এ কাজে আরো ছিলেন জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলীরাও।

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ১৩৮ ব্যক্তি। এর মধ্যে প্রকল্প পরিচালকসহ বড় পদে আছেন ৩২ জন। এঁদের মধ্যে মো. শফিকুল ইসলাম সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে থাকাকালে ২০১১ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক হন। আগামী বছর জুন পর্যন্ত তিনি পরিচালক হিসেবে থাকছেন। ২০১৩ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও সরকার তাঁকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে রেখে দেয়।

বাংলাদেশ ছাড়াও যেসব দেশের মেধায় পদ্মা সেতু হচ্ছে, সেগুলো হচ্ছেÑ চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, জাপান, ডেনমার্ক, ইতালি, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, নেপাল ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ২০টি দেশ এ কাজে মেধা নিয়োগ করেছে।

প্রকল্পে যত কমিটিপদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনটি বড় কমিটি কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে- বিশেষজ্ঞ কমিটি, স্টিয়ারিং কমিটি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। এর মধ্যে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি সবার ওপরে। এই কমিটিতে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা যেকোনো কারিগরি সমস্যার বিষয়ে মতামত দেওয়ার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ।

বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুর পর এই দায়িত্বে আছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামীম জাহান বসুনিয়া। কমিটিতে বাংলাদেশিদের মধ্যে আছেন নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ ও পাইলিং বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হোসাইন মো. শাহীন। আরেক সদস্য মাটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এএমএম সফিউল্লাহ গত বছর মারা যান। বিদেশিদের মধ্যে জাপানের দুজন, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের একজন করে বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।

স্টিয়ারিং ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য নয়জন করে। এঁদের বেশির ভাগ সদস্য সেতু বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। দুই কমিটির মূল কাজ সম্পন্ন, প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন, সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান, প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা ইত্যাদি।

নানা দেশের পণ্য ও সেবা

ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট কম্পন থেকে সেতুকে রক্ষায় ৯৬ সেট ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বিয়ারিং চীনের তৈরি। তবে চূড়ান্ত পরীক্ষা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়।

বাংলাদেশের বাইরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি উপকরণ কেনা হয়েছে চীন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, লুক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মূল সেতুতে প্রায় ২ লাখ ৮৯ হাজার টন স্টিলের প্লেট লেগেছে, যার সবই এসেছে চীন থেকে।

মূল সেতু, নদীশাসন ও সংযোগ সড়কে সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৮৬ হাজার টন। সেতু ও সংযোগ সড়কে রড লেগেছে ১ লাখ ৮ হাজার টন। বালু লেগেছে প্রায় ৬৫ লাখ ঘনমিটার। সংযোগ সড়ক নির্মাণে ইট লেগেছে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। কংক্রিটের ব্লক ব্যবহৃত হয়েছে ৮০ লাখ। সবই দেশীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বেশির ভাগ পাথর এসেছে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। স্টিলের মালামাল ও পানি নিরোধক উপকরণ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। রঙের পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে পাইপ ও পলিমার। বিশেষ সিমেন্ট সিঙ্গাপুর থেকে ও রেলওয়ে গার্ডার এসেছে লুক্সেমবার্গ থেকে। মালয়েশিয়া থেকে এসেছে কেমিক্যাল। এ ছাড়া জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম থেকেও যন্ত্রপাতি এসেছে।

পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদীর বুকে দণ্ডায়মান বিশাল এ স্থাপনা নির্মাণের পেছনেও রয়েছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের গল্প। জার্মানি থেকে হ্যামার, লুক্সেমবার্গ থেকে রেলের স্ট্রিংগার, চীন থেকে ট্রাস, অস্ট্রেলিয়া থেকে পরামর্শক; এমনভাবে বহুদেশ থেকে প্রকৌশলী ও প্রকৌশল যন্ত্রপাতি এসেছে পদ্মায়। ২০ হাজার শ্রমিক-প্রকৌশলীর টুকরো টুকরো মেধা ও শ্রমে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যার নির্মাণকাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ এবং চীনের ৭০০ মেধাবী প্রকৌশলী।

পৃথিবীতে ট্রাস সেতুর ব্যবহার ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে পদ্ধতিটি যে বেশ প্রাচীন, তার প্রমাণ মেলে ফ্রেঞ্চ স্থপতি ভিলার্ড দি কোর্তের ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি স্কেচবুকে। এ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে অসংখ্য বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ, পাকশী সেতুসহ অনেক রেলসেতু ট্রাস প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা।

আর বাকি কিছু যন্ত্রপাতি চীনেরও ছিল। বিভিন্ন সময়ে ১৭টি বড় বড় ক্রেন ও ভারী যন্ত্রপাতি একসঙ্গে কাজ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেনটি দ্বারা তিন হাজার দুইশত টন ওজনের ইস্পাতের স্প্যান বসানো হয়েছে।সার কথা হলো, পদ্মা সেতুতে পাইল বসানো হয়েছে মোট ২৮৪টি। তার মধ্যে ২৬২টি স্টিল আর ২৪টি কংক্রিট, প্রতিটির পরিধি তিন মিটার, মাটির নিচে গেছে ১১৪ থেকে ১২০ মিটার যা পৃথিবীর গভীরতম। মূল সেতুতে স্প্যান বসেছে ৪১টি প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার।

মন্তব্য

Beta version