পদ্মা ও কালনা সেতু চালু হলে আন্তর্জাতিক রুটে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এই রুটটি এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ-১) নামে পরিচিত। জাপান থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক হয়ে বুলগেরিয়া সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। একই সঙ্গে সেতু দিয়ে রেল চালু হলে আন্তর্জাতিক রেল ও সড়ক যোগাযোগে পা রাখবে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর সড়কপথ এএইচ-১ রুটটি বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে যশোর-নড়াইল-কালনা সেতু-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-পদ্মা সেতু-মাওয়া-ঢাকা হয়ে কাঁচপুর-নরসিংদী-শেরপুর-সিলেট দিয়ে তামাবিল পর্যন্ত ৪৯১ কিলোমিটার সড়কপথ অতিক্রম করবে।
এই রুটের দুটি মিসিং লিংক ছিল। একটি পদ্মা সেতু, অন্যটি নড়াইলের কালনা সেতু। পদ্মা সেতু চালুর ফলে এই মিসিং লিংক দূর হবে। এ ছাড়া ছয় লেনের কালনা সেতু নির্মাণকাজও শেষ পর্যায়ে। আগামী সেপ্টেম্বরে কালনা সেতু চালু হওয়ার কথা রয়েছে। তাই পদ্মা ও কালনা সেতু চালু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
তবে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সড়কগুলো খুব হায়ার লেভেল নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু সড়ক রয়েছে ১ নম্বর লেভেল, কিছু আবার ২-৩ নম্বর লেভেল। কিন্তু এখনো সড়কগুলো ৪ নম্বর লেভেল মানে উন্নত হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত সড়কগুলো জাতীয় মহাসড়কে উন্নতিকরণ করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব আনিসুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি সড়ক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে গেছে। এর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে একটি। এ ছাড়া বিবিআইএন, বিমসটেক ও সাসেকসহ আরো কয়েকটি রুটে হয়েছে। আন্তর্জাতিক রুটের ক্ষেত্রে পদ্মা ও যমুনা নদী বড় দুটি বাধা ছিল। এই দুটি সেতু যেহেতু হয়ে গেছে। এখন তেমন আর বড় কোনো সমস্যা নেই। কালনা সেতু সেপ্টেম্বরে চালু হলে এশিয়ান হাইওয়ের আর কোনো মিসিং লিংক থাকবে না। আঞ্চলিক সমস্যার কারণে আন্তর্জাতিক রুটে যুক্ত হতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বসে নেই। আমাদের সড়ক মান উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনটি রুটে যুক্ত হবে
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, তিনটি রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এশিয়ান হাইওয়ে ভুক্ত হবে। এর মধ্যে দুটি প্রধান রুট এএইচ-১, এএইচ-২ এবং একটি উপআঞ্চলিক রুট এএইচ-৪১। এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ) রুট-১’র জাপানের টোকিও থেকে তুরস্ক হয়ে বুলগেরিয়া সীমান্তে পর্যন্ত ২০ হাজার ৫৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। এই রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ যুক্ত হবে। এএইচ-১ রুটটি বাংলাদেশের ৪৯১ কিলোমিটার সড়কপথ অতিক্রম করবে।
এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ) রুট-২ এটি ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান হয়ে ইরানের তেহরানের এএইচ-১ রুটের সঙ্গে যুক্ত হবে। এই রুটে হবে ১৩ হাজার ১৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই রুটের মাধ্যমে ১০ দেশ যুক্ত হবে।
এটি বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে শুরু হয়ে পঞ্চগড়- বেলডাঙ্গা-রংপুর-গোবিন্দগঞ্জ-বগুড়া-হাটিকুমরুল-এলেঙ্গা-কালিয়কৈর-জয়দেবপুর-ঢাকা হয়ে কাঁচপুর-সিলেট দিয়ে তামাবিল পর্যন্ত ৫১২ কিলোমিটার সড়ক বাংলাদেশ দিয়ে অতিক্রম করবে।
এ ছাড়া উপআঞ্চলিক রুট হিসেবে এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ) ৪১-এ মংলা বন্দর থেকে শুরু হয়ে খুলনা-যশোর-ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-পাকশী-দাশুড়িয়া-বনপাড়া-হাটিকুমরুল-কালিয়াকৈর-জয়দেবপুর-ঢাকা-কাঁচপুর-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দিয়ে টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৭৫৪ কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করবে।
১৩ বছর আগে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ
১৯৯২ সালে বেইজিংয়ে ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দি প্যাসিফিক (এসকাপ) বৈঠকে এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে ও ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ফেসিলিটেশন সমন্বয়ে ‘এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়।
২০০১ সালে সিউলের অবকাঠামো কমিটির মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলনে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এসকাপের ৫৮তম সম্মেলনে ৩২ দেশের মধ্যে এ বিষয়ে একটি আন্তঃরাষ্ট্র সমঝোতা হয়।
২০০৫ সালের ৪ জুলাই সাংহাইতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৩২ দেশের মধ্যে ২৬টি দেশ স্বাক্ষর করে। এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ২০০৯ সালের ৫ জুলাই।
আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগের পথ খুলবে
সিঙ্গাপুর থেকে যখন ইউরোপে ট্রেন যাবে তখন পদ্মা সেতু হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু হয়ে যখন এই ট্রেনগুলো যাবে তখন অনেক মালামাল নিয়ে যাবে। সুতরাং হেভি লোডেড সেতু বানানো হয়েছে।’
শফিকুল ইসলাম জানান, তুলনা করলে বাংলাদেশের অন্যান্য সেতু থেকে পদ্মা সেতুর খরচ কম। মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতুতে কত খরচ করেছি। রেলওয়ে সেতুর খরচ কত? সব মিলিয়ে দেখলে খরচ বেশি হয়নি।
খরস্রোতা পদ্মায় সেতু বাস্তবায়নে কী কী রেকর্ড হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বে খরস্রোতা নদী হিসেবে আমাজন নদীর পরই পদ্মার অবস্থান। তাই এই সেতুতে মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসাতে হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি, যা পৃথিবীতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই সেতুর আরেকটি রেকর্ড হচ্ছে বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই সেতুতে ব্যবহার করা ‘ফিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’র সক্ষমতা ১০ হাজার টন। বিশ্বের কোনো সেতুতে এখন পর্যন্ত এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।’
এশিয়ান হাইওয়েভুক্তির জন্য ১৯ প্রকল্পের কাজ চলছে
এশিয়ান হাইওয়েভুক্তির জন্য ১৯ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সাব রিজিওনাল রোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি কারিগরি প্রকল্পের আওতায় সব প্রজেক্টের সম্ভাব্য সমীক্ষা ও ডিটেইলড ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে। কিছু প্রকল্প নির্মাণকাজ চলছে। আবার কিছু প্রকল্প অর্থ সংকটে কাজ শুরু করা যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এএইচ-১ রুটভুক্ত একালায় সড়কগুলো সব পর্যায়ে ৪ লেনের উন্নতি করাসহ জাতীয় মহাসড়কে উন্নয়নের কাজ চলছে। এই রুটভুক্ত করার জন্য সিলেটের তামাবিল থেকে শুরু করে কাঁচপুর পর্যন্ত ২৮৩ কিলোমিটার মহাসড়কে চারলেন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন উন্নতি করা হয়েছে। এই রুটে অন্তর্ভুক্তির জন্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুইপারে ভায়াডাক্টসহ মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া দুইপারের ৬ লেনের ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া এএইচ-২ রুটের জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলের বিভিন্ন সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নয়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সাসেক রোড কানেক্টিভিটি প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সেকশনের ৭০ কিলোমিটার সড়ক ৪ লেন উন্নত করে মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ চলছে। এ ছাড়া এলেঙ্গা থেকে হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর সেকশনের ২৫১ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে চার লেনে উন্নতিকরণের কাজ চলছে।
পঞ্চগড়-রংপুর সেকশনের ১০৬ কিলোমিটার মহাসড়কে ও বাংলাবান্ধা হতে পঞ্চগড় পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে চার লেনে উন্নতিকরণে এডিবির অর্থায়নে নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে বলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্র জানায়।
উপআঞ্চলিক রুট এএইচ-৪১ রুটের বেশিরভাগ সড়কেই দ্বিতীয় শ্রেণি মানের সড়ক। তাই এই রুটের ৭৫৪ কিলোমিটার সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নয়নে কথা রয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ সীমান্ত থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সেকশনের ২৮৮ কিলোমিটার সড়ক মহসড়কে উন্নতির জন্য সমীক্ষা ও নকশা তৈরি কাজ চলছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার সড়ক ৪ লেন উন্নতি করা হয়েছে।
তবে বনপাড়া হতে দাশুড়িয়া-পাকশী-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ পর্যন্ত ১০৫ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে, হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে উন্নতিকরণ, ঝিনাইদহ হতে যশোর-খুলনা পর্যন্ত ১০৭ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে উন্নতিকরণ এবং খুলনা হতে মোংলা পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়েক উন্নতিকরণের প্রকল্পের কাজ চলছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
সড়কের গুণগত মান উন্নয়নের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
তবে চার লেন মহাসড়ক নির্মাণ করলে হবে না, সড়কের গুণগত মান উন্নয়নের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এ বিষয়ে গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক মো. সামছুল হক বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক করিডোরে যুক্ত হওয়ার জন্য দ্রুত মহাসড়কগুলো উন্নত করছে। পাশ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান এমনকি মিয়ানমারও অ্যাক্রসেস কন্ট্রোল (প্রবেশ সংরক্ষিত) সড়ক নির্মাণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন একটি সড়কও নেই। চার লেনের কিছু সড়ক থাকলেও সেগুলোয় দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে রিকশা, ভ্যান, বাইসাইকেল, নসিমন, করিমন চলছে। এশিয়ান হাইওয়ের রুটভুক্ত প্রতিটি মহাসড়কের একই অবস্থা। এগুলোর উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি। প্রবেশ সংরক্ষিত সড়ক নির্মাণ না করলে শুধু চার লেন কেন আট লেন সড়ক করলেও গুণগত মানের উন্নয়ন হবে না।
মন্তব্য