-->

ঢাকা থেকে ৩০ মিনিটেই পদ্মায়

#আসা-যাওয়া যানবাহনের চাপ বাড়ল #নতুন চাপে ট্রাফিক বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা থেকে ৩০ মিনিটেই পদ্মায়

চালু হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। রোববার ভোর থেকেই নেমেছে যানবাহনের চাপ। রীতিমতো ঢল বললেও ভুল হবে না। প্রায় তিন কিলোমিটারের বেশি যানবাহনের জটলা ছিল সেতু এলাকা। দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার যানবাহন বেশি এলেও ঢাকা থেকে পদ্মামুখী গাড়ির চাপ ছিল অনেক বেশি। যানবাহনের চাপ সামলাতে রীতিমতো ট্রাফিক বিভাগকে হিমশিম খেতে হয়েছে।

এদিকে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত যেতে সময় লাগছে মাত্র আধাঘণ্টা। তাই রোববার অফিস খোলা থাকলেও উৎসুক অনেকেই সেতু দেখতে নিজস্ব পরিবহণ বা বাসে করে যান। বিশে^র ১১তম দীর্ঘ এই সেতুর প্রথম দিনের যাত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ইতিহাসের অংশিদার হতে চান অনেকেই। পদ্মা সেতু থেকে কেরানীগঞ্জ এসে রাজধানীতে প্রবেশের দুটি পথ তৈরি হয়েছে।

 

এগুলো হলো, পোস্তগোলা ও বাবুবাজার সেতু। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটসহ উত্তরাঞ্চলের যানবাহন পদ্মা সেতু হয়ে যাতায়াত করতে হলে ঢাকার ওপর দিয়েই যেতে হচ্ছে। তাই প্রথম দিনে রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকা থেকে পদ্মামুখী যানবাহন বেশি দেখা গেছে। তাছাড়া পদ্মা থেকে ঢাকামুখী আসার যানবাহন বেশি নেমেছে এই এলাকা দিয়েই।

প্রথম দিনে গাড়ির চাপ ৪০ কিলোমিটার দূরে ঢাকার চাঁনখারপুল থেকেও তা বেশ ভালোভাবেই টের পেতে শুরু করেছেন ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। ওই এলাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পেছনের সড়কে রোববার সকাল থেকে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. আতিক। হাত নেড়ে গাড়িকে সংকেত দিতে দিতেই তিনি বললেন, অন্য দিনও ভিড় থাকে, তবে এখন দম ফেলার অবকাশ পাচ্ছেন না।

‘বুঝতেছেন! কত গাড়ি ঢাকায় ঢুকতেছে, সব ব্যক্তিগত গাড়ি। আগে এত গাড়ি ঢাকায় ঢুকত না, এখন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে আসতেছে।’

ছয় কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এই ২১টি জেলার মাওয়া রুট ব্যবহারকারী বাসসহ যানবাহনগুলো এত দিন ফেরিতে পারাপার হতো। এখন কমপক্ষে ২৯ জেলার মানুষ এই সুফল পাবে।

এখন পদ্মা সেতু পার হয়ে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যানবাহন আসছে কেরানীগঞ্জ থেকে বুড়িগঙ্গা সেতু আর বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে ঢুকছে ঢাকায়। একই পথে ঢাকা থেকে শয়ে শয়ে যানবাহন ছুটছে পদ্মা সেতুর দিকে।

শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর রোববার সকাল ৬টায় সেতুর দুই প্রান্তের ১৪টি টোল গেট খুলে দিলে বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন টোল দিয়ে সেতু পার হতে শুরু করে।

ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক আতিক বলেন, ভোরবেলা থেকে এই অবস্থা। অনেক অনেক গাড়ি ঢুকতেছে ঢাকায়, আর ফুলবাড়িয়া দিয়ে গাড়ি ভরে মানুষ বের হচ্ছে। গাড়ি সামাল দিতে হাত নেড়ে কুল পাচ্ছি না।’

কেরানীগঞ্জের কদমতলী ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক পীযূষ কুমার মালো বলেন, চুনকুটিয়ায় হাইওয়ে সড়ক দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে নামা ও ওঠার যে লেইন আছে, সকাল থেকে প্রচুর গাড়ি ওই লেন ধরে যাওয়া আসা করেছে। প্রথম ধাক্কা সামলানোর পর সকাল ১০টার দিকে গাড়ির চাপ একটু কমেছে। তবে যানজট হয়নি কোথাও।

সকাল থেকে ফুলবাড়িয়ায় দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. মাসুম। তিনি বললেন, ভোর থেকে এ এলাকায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়, বেশির ভাগই যাচ্ছেন পদ্মা সেতু দেখতে। এক মুহূর্ত অবসর পাচ্ছি না। এত গাড়ি যাচ্ছে, সব সামলে বের করে দিচ্ছি।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ মুনিবুর রহমান বলেন, ‘শনিবার গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। রোববার অফিস খোলাসহ একটা চাপ থাকে। তাছাড়া পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আসা কিছু গাড়ি ঢাকায় ঢুকছে, কিছু ফ্লাইওভার ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম রোডের দিকে চলে যাচ্ছে।’ তার ভাষায়, সকালে অফিস আদালত খোলার সময়টায় সেতু হয়ে আসা গাড়ি বাড়ায় চাপ বেশি মনে হয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

উত্তরবঙ্গ বা ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে সরাসরি সড়ক পথে দক্ষিণবঙ্গে যেতে হলে ঢাকার ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুতে উঠতে হবে। আবার ফিরতি পথেও সেসব গাড়িকে রাজধানী পার হতে হবে। চট্টগ্রাম বা সিলেটগামী যানবাহনও ঢাকার যাত্রাবাড়ী হয়েই যায়। ঢাকাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ না থাকায় রাজধানীর ওপর যে যানবাহনের চাপ বাড়বে, সে বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা।

তাদের ভাষ্য, এত দিন পদ্মা পার হতে হত ফেরিতে। তাতে কিছু সময়ক্ষেপণ হতো। ফলে এক সঙ্গে অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশের সুযোগ ছিল না।

কিন্তু সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের গাড়ি দ্রুতই ঢাকা চলে আসবে। পদ্মা সেতু থেকে নেমে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ঢাকার সড়কগুলোকেই। একইভাবে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকার ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুর দিকে যাবে গাড়ি।

তাতে ঢাকার প্রবেশপথ, বিশেষ করে বাবু বাজার ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জগামী রাস্তা, পোস্তগোলা থেকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার রাস্তায় যানজট বাড়বে।

সেতু উদ্বোধনের আগে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করবে, বের হবে, সেখানে ঢাকায় চাপ একটু হবেই, সেটা মোকাবিলার পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে আমরা এগোচ্ছি।’

৩০ মিনিটেই পদ্মায় : এদিকে রাজধানী থেকে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক) হয়ে পদ্মা সেতুর মাওয়া টোল প্লাজা প্রান্তে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২৫ মিনিট। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, জিপ ও মোটরসাইকেলে লাগবে এ সময়। আর পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৬-৭ মিনিট। অর্থাৎ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পার হতে মোট সময় লাগবে ৩২ মিনিটের মতো। তবে বাসে করে যেতে সময় লাগবে আরেকটু বেশি। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টার কম সময়ে বাসে করে পদ্মা পাড়ি দেয়া সম্ভব।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। ২০২০ সালের ১২ মার্চ এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পদ্মা সেতু।রোববার সকাল ৬টা থেকে পদ্মা সেতু সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার পর থেকে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাড়ি দিতে পারছে পদ্মা সেতু। এর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হলো দক্ষিণবঙ্গের অর্থনীতির নতুন এই করিডোর।

ঢাকার প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এই এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সাধারণভাবে সময় লাগবে মাত্র ৪২ মিনিট। আর ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে সময় লাগবে ২৫ মিনিট। যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া রোডে উঠলে এই এক্সপ্রেসওয়ে সোজা নিয়ে যাবে পদ্মা সেতুর দ্বারে।

সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি দেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা পদ্মা সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এই সেতুর এক অংশে পদ্মা নদীর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একই সঙ্গে ট্রেন ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে।

চার লেনবিশিষ্ট ৭২ ফুট প্রস্থের এ সেতুর নিচতলায় রয়েছে রেল লাইন। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। আগামী বছর রেল চালু হবে বলে আশা প্রকাশ করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা থেকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে পদ্মা সেতু দেখতে আসা বিল্লাল হোসেন বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে যদি কোথাও যানজট না থাকে, তবে মাত্র ২৫ মিনিটে পদ্মা সেতুর মাওয়া টোল প্লাজায় আসা সম্ভব। টোল প্লাজায় খুব বেশি সময় লাগছে না। মাত্র ৩০ সেকেন্ড থেকে ৪০ সেকেন্ডেই টোলের টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে। মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দেখতে আসা আতিক হাসান বলেন, মোটরসাইকেলের স্পিড ৭০-৮০ কিলোমিটার বেগে হলে ২০ থেকে ২৫ মিনিটে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব।

মন্তব্য

Beta version