-->

আবার বন্যার আশঙ্কা

শাহীন রহমান
আবার বন্যার আশঙ্কা
ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

ভারী বৃষ্টিপাত থেমে যাওয়ায় বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চল থেকে পানি এখন অনেকটাই নেমে গেছে। সুনামগঞ্জ বন্যামুক্ত হয়েছে। সিলেট শহর থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, মধ্য জুলাই নাগাদ ফের বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, এই মুহূর্তে বন্যা পরিস্থিতির আর অবনতির আশঙ্কা নেই। তবে যেহেতু বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতি বছর এই মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উল্টর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট-সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পুনরায় বন্যায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পানি ও বৃষ্টির কারণে দেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিমি এলাকা বা ১৮ শতাংশ ভূখ- বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। দেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮ লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বাৎসরিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১ লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।

#মৌসুমের কারণেই স্বাভাবিক নিয়মেই বন্যার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

তারা বলেন, অবস্থানগত কারণে ভাটির এই ভূখ-ে তিন ধরনের বন্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে মৌসুম বা ঋতুর কারণে মৌসুমি বন্যা দেখা দেয় প্রতি বছর। এই বন্যা ঋতুগত হওয়ায় নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, প্রতি বছর মধ্য জুলাই নাগাদ এই বন্যা দেখা দেয়। এবারও এই সময়ে বন্যা দেখা দিতে পারে।

ইতোমধ্যে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই বন্যা দেখা দিতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূইয়া বলেন, দেশে বর্ষা ঋতু শুরু হয়েছে। প্রতি বছর এই মৌসুমে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ে। এ কারণে এসব অঞ্চল আরো এক দফায় প্লাবিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এর বাইরে আকস্মিক বন্যা যা আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয়। ইতিমধ্যে সিলেট সুনামগঞ্জে দুই দফায় আকস্মিক বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছে, উজানে পাহাড়ি ঢলের কারণেই মূলত বন্যার সৃষ্টি।

গত দুই মাসের মধ্যে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট-সুনামগঞ্জ। তবে এবারের বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সিলেটে কেন এত ঘন ঘন বন্যা? গবেষকরা বলছেন, অতিবৃষ্টির কারণেই এই বন্যা। তবে এর বাইরেও বেশ কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেছেন তারা। এবারের বন্যা এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট সবই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। পুরো সিলেট শহর এবার পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ৪০ লাখ মানুষ। বিদ্যুৎহীন ও পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সিলেট সুনামগঞ্জ।

ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, অনেক সময় স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই বন্যার সৃষ্টি হয়। এবারও তাই হয়েছে। কয়েক বছর পরপরই এটা হয়ে থাকে। এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের দায় কিছুট রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, প্রতি শতাব্দীতে এই বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে। যেগুলো ব্যাপকতায় ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার প্রায় সমান। ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার, ভয়াবহ বন্যা গড়ে ছয়-সাত বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি সাত বছরে একবার ব্যাপক বন্যা আর ৩৩-৫০ বছরে একবার মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটে এবারই যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে তা নয়। ১৯৬৮ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় সাত লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১৯৮৭ সালে সারা দেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হলেও ১৯৮৮ সালের বন্যা গত শতকের অন্যতম ভয়াবহ। যাতে ৬০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাপক প্রাণহানি হয়।

এছাড়া ১৯৯৮ সালে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দুই মাসের বেশি বন্যাকবলিত থাকে, যা ১৯৮৮ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনীয়। এর বাইরে ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালেও ভয়াবহ বন্যায় পড়ে বাংলাদেশ।

তারা বলছেন, ভারী বৃষ্টিপাত, হিমালয়ের তুষার গলা, পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট/দখল বা ভূমিধস, প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি, প্রকৃতির উপর মানবীয় হস্তক্ষেপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মূলত বন্যা দেখা দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার জন্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকেও দায়ী করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি সেলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

তারা বলছেন, মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী আছে। ভারত ইচ্ছেমতো সেখানে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিচ্ছে। উন্নয়নের নামে সিলেটের হাওর অঞ্চল ভরাট, রাস্তা, বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহে বাধা দেয়াকেও চলতি বন্যার কারণ হিসেবে অভিহিত করেছে তারা।

১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার। কাঠামোগত প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১১টি নির্দেশনামূলক নীতি প্রণয়ন করা হয়। এর অংশ হিসেবে বর্তমানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে সরকার। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।

একই সঙ্গে কাঠামোগত পদক্ষেপের বাইরে বিকল্প কৌশল হিসেবে অবকাঠামোগত পদক্ষেপগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলেন তারা। এর মধ্যে আছে নদনদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগসহ শস্যের বহুমুখীকরণ। আর সবশেষ প্লাবনভূমিগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা এবং উন্নয়ন কর্মকা-কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে উজান থেকে পানি আসা বন্ধ হবে না। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিলেট বিভাগের বন্যা এর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এর আগেও এই এলাকায় ভয়বহ বন্যা দেখা দিয়েছে। তখন লাখ লাখ মানুষ ক্ষতির শিকার হয়। মূলত আকস্মিক বন্যার কারণে এই দুর্যোগের শিকার হতে হচ্ছে। তবে মৌসুমি বন্যা মৌসুম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

এ কারণে মধ্য জুলাইয়ে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলে ফের বন্যা দেখা দিতে পারে। তবে তা ভয়াবহ হবে কি না তা এখই বলা যাচ্ছে না। মৌসুমগত কারণে দেশে আগস্টেও আরেক দফা বন্যার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে পদ্মা নদীর পানি বেড়ে যাওয়া এই নদীর উজানে বিহারে ভারী বৃষ্টির কারণে দেশে বন্যা পারিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের বর্ষা মৌসুম বলে ধরা হয়।

 

মন্তব্য

Beta version