ঢাকা: বঙ্গোপসাগরে দেশের সীমানা নির্ধারণের পর সুনীল অর্থনীতির নতুন দিগন্ত খুলেছে। অমিত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে অর্থনীতির প্রসারে। সমুদ্রকেন্দ্রিক সম্পদ ও পর্যটনকেন্দ্র সৈকতকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে- এ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটনকে নতুন করে সাজাতে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। নেয়া হয়েছে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠছে বিভিন্ন রকমের অবকাঠামো। ৮ বছর আগে এ অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সদিচ্ছার অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সবকিছুই পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে।
তাদের মতে, অভ্যন্তরীণভাবে একটি ভালো পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এখন প্রয়োজন পর্যটকের নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক টানা। এটা করতে হলে সরকারি পর্যটন করপোরেশনকে আরো বেশি দক্ষ ও ভূমিকা নিতে হবে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্রসৈকতকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, সেগুলোর মধ্যে পাঁচটি স্বল্পমেয়াদি, দুটি মধ্যমেয়াদি এবং সাতটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির পর এসব কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সমুদ্রে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার স্বত্বাধিকার পায়। এতে সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের সামনে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় খনিজ সম্পদ উত্তোলনে আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মৎস্য সম্পদ আহরণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপগুলো হলো- কক্সবাজারের খুরুশকুলে শেখ হাসিনা পর্যটন জোন নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করতে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের জলক্রীড়াসহ বীচকেন্দ্রিক পর্যটন সুবিধা চালু করা। এর মধ্যে লাইটিং চেঞ্চিং ও ক্লোসেট, বীচ ফুটবল, শৈবাল পয়েন্টে সী-ফুড, স্থানীয় ও দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করতে বিনোদনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা এবং জেট স্কি সংগ্রহ করা হবে। পর্যটনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো হলো- চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পারকি সমুদ্রসৈকতকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া। যেখানে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ হাব, সিনেপ্লেক্স, হোটেল রিটেইল সপ, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেটেরিয়া, জিমনেসিয়াম, ব্যাঙ্ককুয়েট হল, স্পা ও অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো স্থাপনা হবে।
পর্যটনের প্রসারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে বেজা কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সুবিধাসংবলিত স্থাপনা গড়ে তোলার জন্য ৫ বছর মেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে যে জমির প্রয়োজন, তা সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ইতোমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর। সাগরকেন্দ্রিক পর্যটনকে সর্বোচ্চ ব্যবহার ও বিকাশে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও বন্দরের পাশের এলাকায় পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এখানে ‘পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। কক্সবাজারে খুরুশকুলে শেখ হাসিনা টাওয়ারসহ পর্যটন জোন নির্মাণ ও মহেশখালীতে অ্যান্টারটেইনমেন্ট ভিলেজ স্থাপন করবে পর্যটন করপোরেশন। এজন্য মহেশখালীতে ২৫৫ একর জমি পেতে বেজাকে চিঠি দিয়েছে। আগে থেকেই সমুদ্রসৈকতে সরকারি-বেকরকারি অবকাঠামো রয়েছে। যেখানে অভ্যন্তরীণ বড় একটি পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পর্যটন মৌসুমে স্থান সংকুলানের জায়গা থাকে না। হোটেলগুলোয় জায়গা পাওয়া যায় না।
পর্যটনসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সমুদ্র জয়ের সীমানা নির্ধারণের পর যেসব পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, এখনো তা কাগজে-কলমে রয়েছে। এখন সৈকতকেন্দ্রিক যে পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে নিরাপত্তাটি খুব জরুরি। এ নিরাপত্তা দিতে হবে বিমানবন্দর থেকে কক্সবাজার পর্যন্তÑ যাতে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট হয়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, পর্যটনের বিকাশে পরিকল্পিতভাবে বীচ সাজাতে হবে, ট্যুরিস্টদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, সৈকত এলাকায় পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করতে হবে- যাতে পর্যটনের পরিবেশ ব্যাহত না হয় এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, পর্যটনের যে বেহাল অবস্থা, এটা দূর করতে বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাড়ির কাছেই ভারতের সিমলা, যোদপুর বা মালদ্বীপেরে মডেলটি অনুসরণ করলেই চলবে। আরো খানিক দূরে যেতে চাইলে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরকে অনুসরণ করা যেতে পারে। পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে। এগুলো দূর করতে পারলে সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রায় এক দশক হলো, এখন পর্যন্ত পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে। পর্যটনের ক্ষেত্রে পর্যটন স্পটগুলোর আশপাশে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে। এগুলো রক্ষা করতে হবে। পরিকল্পনা গতি না পেলে পর্যটন এগোনোর আগেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। পর্যটনকেন্দ্রের স্থানগুলো এখনো পর্যটন করপোরেশনের হাতে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এগুলো সরকারি-বেসরকারি যৌথভাবে উদ্যোগে নিয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো যদি পর্যটনের উপযোগী না থাকে, পর্যটকরা যদি নিরাপত্তা না পান, খাদ্য না পান, তাহলে তারা আসবেন না। ফলে পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখবে না।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য