-->
শিরোনাম
হারিয়ে যাচ্ছে টাইপ মেশিন

সুদিন ফিরবে না টাইপিস্টদের

ইফ্ফাত শরীফ
সুদিন ফিরবে না টাইপিস্টদের

ঢাকা: মোহাম্মদ ইউসুফ মিয়া। বয়স ৭০ বছর ছুই ছুই। কিন্তু এখনো টাইপ মেশিনে আঙুল রেখে অনবরত টাইপ করে চলেছেন। কথা বলে জানা গেলো, মিনিটে ৬০ শব্দ নিখুঁতভাবে টাইপ করতে পারেন এ দক্ষ প্রবীণ টাইপিস্ট। রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় একটি চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে টাইপিস্টের কাজ করছেন তিনি।

 

ইউসুফ মিয়া জানান, ৪০ বছর আগে যখন ঢাকায় টাইপিস্টের কাজ শুরু করি, তখন এ পেশা রমরমা ছিল। দম ফেলার ফুরসত মিলত না। ভালোই আয় হতো। তাই সে সময় সাঁটলিপিকার ও মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে সরকারি চাকরি পেয়ে তা ছেড়ে নিজ উদ্যোগে টাইপিস্টের ব্যবসা শুরু করি। তখন কম্পিউটার আসেনি। এ কারনে দিনে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা আয় হতো। তবে এখন আর সেই রমরমা ব্যবসা নেই। সেই সুদিন আর ফিরে আসবে না।

 

প্রযুক্তির বদলের কারণে বর্তমানে টাইপিস্টের প্রয়োজন একেবারেই কমে গেছে। তবু এখনো অনেকে ধরে রেখেছেন পুরনো সেই পেশা। গুলিস্তান, দৈনিক বাংলার মোড়, মতিঝিলসহ ঢাকার যে অঞ্চলগুলোতে টাইপিস্টরা সারিবদ্ধভাবে বসে কাজ করতেন, সেখানে তাদের আর তেমন দেখা যায় না। এক সময় সরকার এ টাইপিস্টদের বসার জন্য দৈনিক বাংলার মোড়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সামনে একটি শেড করে দিয়েছিল। একটা সময় ছিল টাইপিস্টরা কাজে ব্যস্ত সময় পার করলেও এখন আর তাদের সেই ব্যস্ততা নেই। তারা যে যেভাবে পারছে জীবন জীবিকা চালানোর চেষ্টা করছেন।

 

গত বুধবার সকালে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের পাশে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতে ছাউনির নিচে ৮-১০টা টাইপিস্টের দোকান। সেখানে কয়েকজন বৃদ্ধ ও মধ্যবয়সি টাইপিস্ট বসে সময় পার করছেন। সেখানে একজন টাইপিস্ট মো. আবু বক্কর। ৬ বছর যাবৎ এখানে নোটারি ও অনুবাদের পাশাপাশি টাইপ রাইটারের ব্যবসা করছেন। টাইপিস্ট হিসেবে আগে বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু বয়স হওয়াতে এখন আর তাকে কেউ কাজে নিচ্ছে না। তাই নিজ থেকেই টাইপ রাইটারের কাজ করে জীবিকা চালানোর চেষ্টা করছেন। হাতে বেশি কাজ নেই। অপেক্ষা করছেন কখন কাজ আসবে। সেদিন সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ১২০ টাকা আয় করেন। তিনি বলেন, এমনও দিন যায়, এক টাকাও আয় হয়না।

 

এক প্রকার ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, আগে এ পেশার প্রতি এক ধরনের ভালবাসা কাজ করতো। তবে সে ভালবাসা এখন আর কাজ করছে না। আর কোনো কাজ জানিনা দেখে এখনো এ পেশায় পরে আছি। চারিদিকে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধগতিতে কাজ করে বাঁচব কীভাবে সে চিন্তা করি। আগে অবস্থা খুব ভালো ছিল। সারাদিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পাইতাম। এখন একদিন কাজ থাকলে তিনদিন থাকে না। ২৫০-৩০০ টাকা পাই তাতে সংসার চলে না।

 

তিনি বলেন, আমাদের একটা সংগঠন ছিল ‘পেশাগত মুদ্রাক্ষরিক সমিতি’ নামে। এটা পুরো দেশব্যাপী ছিল। বর্তমানে এ সংগঠনের কোনো অস্থিত্ব নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে সরকারের পক্ষ থেকে টাইপিস্টদের বসার জন্য দৈনিক বাংলার মোড়ে একটা ঘর করে দেয়া ছিল। দিন দিন টাইপ রাইটারের চাহিদা কমায় একটা সময় এ ঘর ভেঙে ফেলা হয়। এখন আমরা টাইপিস্টরা ফুটপাতে যে যেভাবে পারি বসে কাজ করছি।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় আদালত প্রাঙ্গণ, ভূমি অফিস, নগর ভবন, রাজউক ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস সংলগ্ন কোনো গাছের নিচে সারিবদ্ধ হয়ে কাজ করতেন টাইপিস্টরা। তবে এ চিত্র এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। টাইপ রাইটারের কাজের সঙ্গে যাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর ছিল তা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বেকার হয়েছেন। আবার অনেকে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেও এখনো সেই টাইপ মেশিনকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকেই পেশা বদলাচ্ছেন।

 

এমনই একজন মেরাদিয়া বড় বাড়ি কবরস্থান এলাকার বাসিন্দা টাইপিস্ট মো. কামাল। ৭ থেকে ৮ বছর আগে নিজের টাইপ মেশিনটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে পেশা বদলিয়ে নোটারির ব্রোকার হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি একটি ফটোকপির দোকান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, টাইপ রাইটারদের সে সুদিন আর ফিরে আসবে না। একটা সময় ছিল এ কাজের অনেক চাহিদা ছিল। তখন মানুষ টাইপিংয়ের কাজ শিখত চাকরি পাবার জন্য।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version