-->

গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তথ্যেই ধূম্রজাল

শাহীন রহমান
গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ
প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তথ্যেই ধূম্রজাল
গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তথ্যেই ধূম্রজাল

গাইবান্ধা উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণার পর সারা দেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। এই বিতর্ক সরকারি দল থেকে যেমন উঠছে, তেমনি বিরোধী দলগুলো থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়মের মুখে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করা ছিল ইসির সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে ইসির সিদ্ধান্ত সঠিক-বেঠিক যাই হোক এ নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা আরো বাড়িয়ে তুলছে ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালন করা প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা দুই ধরনের তথ্য দিচ্ছেন। ফলে এই নির্বাচন বন্ধ করার বিষয়ে তৈরি হয়েছে একধরনের ধূম্রজাল।

 

নির্বাচন বন্ধ ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক প্রিসাইডিং কর্মকর্তার চিঠি ভাইরাল হয়। সেখানে তারা উল্লেখ করেন, তাদের কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হচ্ছিল। কিন্তু ইসির সিদ্ধান্তের কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এ ধরনের চিঠির বিষয়ে আবার পরে অনেকে স্বীকার করেছেন, স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের চাপের মুখে তারা এমনটি করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তার কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের পরিবেশ সত্যিই ভালো ছিল।

 

গত ১২ অক্টোবর ছিল গাইবান্ধ-৫ আসনের উপনির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে ইভিএমে ১৪৫ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কেন্দ্রে নিরাপত্তা ও ভোট জালিয়াতি রোধে সব কেন্দ্রেই সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। আগারগাঁও নির্বাচন অফিস থেকে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া তদারকি করে ইসির পর্যবেক্ষণ টিম। এতে বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালটের গোপন কক্ষে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তির প্রবেশ ও একজনের ভোট অন্যজন দিয়ে দেয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই অনিয়মের কারণে ৫০ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরে ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরো আসনের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, ভোট বন্ধে ইসি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়নি। ভোট জালিয়াতির ঘটনায় সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

 

ঢাকায় বসে সিসিটিভি দেখে ভোটগ্রহণ বন্ধে ইসির এমন সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ঢাকায় বসে ইসি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভোট বন্ধের কারণ স্পষ্ট নয় বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ইসির এ ধরনের সিদ্ধান্তে জনগণ অবাক হয়েছে। গাইবান্ধার ভোট বন্ধ করাকে বিএনপি ইসির কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারা বলছেন, ইসি নিজেদের সত্যতা প্রমাণের জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জনগণ তাদের পাতা ফাঁদে পা দেবে না।

 

তবে ইসির ভোট বন্ধ ঘোষণা করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু চিঠি ভাইরাল হয়েছে। যেখানে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ভোট সুষ্ঠু হওয়ার পরও বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তবে এ বিষয়ে একেকজনের একেক ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। কেউ বলছেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। আবার অনেকেই বলছেন, ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, স্থানীয় লোকজনের চাপে পড়ে তারা সাদা কাগজেই সই দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের এ বক্তব্যে বিভ্রান্তি আরো বাড়ছে।

 

সমরপড়া দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন মশিউর রহমান। তিনি নির্বাচন কমিশন বরাবর চিঠিতে লিখেছেন, তার কেন্দ্রে ভোট সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশে তিনি ভোটগ্রহণ বন্ধ করেন।

 

উদয়ন মহিলা কলেজের প্রভাষক প্রিসাইডিং অফিসার মাহমুদুল হাসান। তিনি বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন। মাহমুদুল হাসান স্বহস্তে লেখা চিঠিতে বলেন, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের নির্দেশে ভোটকেন্দ্র পরিত্যাগ করলাম। পরে বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণার পর তারা কেন্দ্র ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেন। এ সময় স্থানীয় জনগণ তাদের ঘিরে ধরেন এবং লিখিত ভোটের ফলাফল চান। তাদের চাপের মুখে সাদা কাগজে লিখিত ফলাফল দিয়ে মালামালসহ কেন্দ্র ত্যাগ করেন।

 

নলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা এ কে এম জুলফিকার হায়দার চিঠিতে লিখেছেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি এ কে এম জুলফিকার হায়দার প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ১১৩নং নলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৪৮০টি। আমরা বিকেল ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

 

মোংলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. কামরুজ্জামান চিঠিতে লেখেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মো. কামরুজ্জামান প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ১২৮নং মোংলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৬৮৯টি। আমরা বিকেল ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’ মুন্সিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং অফিসার শাহ আলম লিখেছেন, ‘সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মো. শাহ আলম প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ৭৬নং মুন্সিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে আনুমানিক ৬৫০টি। আমরা ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

 

জাদুরতাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আবদুল লতিফও সাদা কাগজে চিঠি দিতে বাধ্য হন বলে জানান। তিনি বলেন, স্থানীয় মানুষ তাদের ঘেরাও করে রাখেন। লিখিতভাবে ভোটের ফলাফল দিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে বলেন তারা। তবে ৯৮ নম্বর বড়াইকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মশফিকুর রহমান দাবি করেন, ভোটগ্রহণের সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো ছিল। সকালে একটু ঝামেলা হলে পুলিশ দিয়ে ভোটারদের লাইন ঠিক করে দেন।

 

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেন, প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ভোট সুষ্ঠু হওয়ার যে নোট লিখেছেন তা ইসি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পায়নি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। কোনো কর্মকর্তা সত্য লুকিয়ে থাকলে তা তদন্তে প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে ইসির অনড় অবস্থান রয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির প্রস্তুতি থাকলে এভাবে পুরো ভোট বন্ধ করতে হতো না। ইসির উচিত ছিল পরিস্থিতি দেখে আগেই ব্যবস্থা নেয়া।

মন্তব্য

Beta version