-->
শিরোনাম

এনআইডি নিজেদের কাছে রাখতে শেষ চেষ্টা ইসির

শাহীন রহমান
এনআইডি নিজেদের কাছে রাখতে শেষ চেষ্টা ইসির

শাহীন রহমান: প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ (এনআইডি) ইসির হাতেই রয়েছে। এই নিবন্ধন অনুবিভাগে একজন ব্যক্তির ডাটাবেজ যেমন সংরক্ষিত রয়েছে, আবার এই ডাটাবেজ ধরেই প্রণয়ন করা হচ্ছে ভোটার তালিকা। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ সরকারের অধীনে নেয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চুড়ান্তকরেছে সরকার।

 

সরকারি এ সিদ্ধান্তে বারবার বিরোধিতা করে আসছে ইসি। এবার শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হচ্ছে। ইসি মো. আলমগীর বলেছেন, এনআইডি নিজেদের কাছে রাখতে দ্রæতই রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দেয়া হবে।জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করতে আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে ইসির পরিবর্তে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০০৭ সাল থেকে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন কাজের অংশ হিসেবে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আসছে ইসি। তারাই এখন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনের সব কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইসিকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিবেচিত বিধায় সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বগুলোর মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

 

জাতীয় পরিচয়পত্র আইন ২০১০ সংশোধন করে ‘নির্বাচন কমিশন’-এর পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যেতে পারে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল ইসি থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ থেকে এনআইডি হস্তান্তর করার জন্য ইসিকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে এনআইডি নিজেদের কাছে রাখার সুবিধা তুলে ধরে পাল্টা চিঠি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে তার কোনো জবাব না মিললেও নতুন আইন প্রণয়নের দিকেই যাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

 

সোমবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে ইসি মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সবার সঙ্গে কথা বলেই রাষ্ট্রপ্রতিকে এ বিষয়ে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এনআইডি ইসিতে থাকার ভালো দিক আছে। আবার জিনিসটা হলো সরকারের জিনিস। আমাদের কাছে দিয়ে রেখেছিলেন, এখন সরকার নিয়ে যেতে চান, প্লাস-মাইনাস অনেক বিষয় আছে। রাষ্ট্রপতি যেহেতু রাষ্ট্রের প্রধান, আমাদের গার্ডিয়ান, সরকারেরও গার্ডিয়ান। কাজেই আমরা উনার কাছেই পাঠিয়ে দিই উনি যেটা ভালো মনে করেন, সেটাই হবে।

 

তিনি বলেন, এখন আইন করে যদি নিয়ে যেতে চায় তাহলে বাধা দেয়ার কিছু নেই। তবে সরকার এটা নিতে চাইলে আলাদা লোকবল এবং টেকনিক্যাল অবকাঠামো করতে হবে। সেটা সরকারের জন্য অবশ্যই খরচের বিষয়, চ্যালেঞ্জের বিষয় আছে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষও। সরকার নিতে চাইলেও সময় লাগবে। এত তাড়াতাড়ি নিতে পারবে না। কারণ একটা সিস্টেম থেকে আরেকটা সিস্টেমে নিয়ে যাওয়া এটা বেশ সময় লাগবে। সংসদে আইন পাস করতে যেমন সময় লাগবে।

 

 

তবে সরকার এনআইডি ইসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তান্তরের বিরোধিতা করে আসছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারও। তারা বলেন, ২০১০ সালের পরিচয়পত্র আইন বহাল থাকা অবস্থায় এটা কখনো সরকার তার অধীন কোনো সংস্থার কাছে নিতে পারে না। গত মাসে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে বন্ধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য ইসিতে ডাকা হয় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের। সেখানে এনআইডি সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিত করে বক্তব্য দেন তারা।

 

বলেন, সরকার যদি এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে যায়, তাহলে ভোটার তালিকায় বড় গন্ডগোল হবে। এটা নিয়ে বিরাট ঝামেলা হবে।এনআইডি সম্পর্কে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ তার মত দেন যে, ডাটাবেজটা সব জায়গায় থাকতে পারে, বিভিন্ন অফিসে থাকতে পারে, অসুবিধা নেই। কিন্তু মূলটা ইলেকশন কমিশনের হাতে থাকা উচিত।

 

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদও ইসি থেকে এনআইডি হস্তান্তরের বিরোধিতা করে বলেন, এনআইডিটা একটা সমন্বিত অংশ। ভোটার তালিকা থেকেই এসেছে। এটি চলে গেলে ভোটার হতে চাইবে না লোকজন। এখানে নির্বাচন কমিশনে এটার বিরাট বড় ডাটাবেজ আছে এবং সুরক্ষিত আছে। এটা ভালো সিস্টেম হয়ে আছে, সেই ভালো জিনিসটাকে আরও মজবুত করা উচিত। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, এনআইডি নির্বাচন কমিশনের তৈরি একটা জিনিস। এটা নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকলে কোনো অসুবিধা হয় না সরকারের।

 

সুতরাং এনআইডির সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের বা ভোটার তালিকার পুরোপুরি সম্পর্ক আছে। এটা মাঝখান থেকে ধরে নিলে নির্বাচন কমিশনের কাজে অসুবিধা হবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা আলাদা হলে কোনো এক সময় ভোটার তালিকা নিয়ে কথা উঠবে। তখন বলবে কারটা ঠিক? এনআইডি নাকি ভোটার তালিকা? এটা নিয়ে একটা গন্ডগোল হবে।

 

নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালন করা সাবেকরা এনআইডি হস্তান্তরের বিরোধিতা করে বলেন, এনআইডি অনুবিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিতে চায়। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিষয়ে আলাদা আইন রয়েছে। এই আইন থাকা অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেন আর যেই বলেন, নিতে পারবে না। এখানে স্পষ্ট বলা আছে, জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সবকিছু নির্বাচন কমিশন করবে।

 

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ইসির তথ্য ভান্ডারে ১১ কোটি ৩২ লাখ নাগরিকের তথ্য রয়েছে, যাদের প্রায় সবারই লেমিনেটিং করা এনআইডি রয়েছে। এই এনআইডি সার্ভারের মাধ্যমেই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের পরিচয় শনাক্তসাপেক্ষে সেবা দিচ্ছে। আর এতে সরকারের রাজস্ব বাড়াতে অবদানও রাখছে ইসি। প্রায় ১৪০টি প্রতিষ্ঠান ইসির জাতীয় ভোটার তথ্য ভান্ডার থেকে নাগরিকদের তথ্য যাচাই সেবা নিয়ে থাকে।

 

পাসপোর্ট ইস্যু, বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় (বিশেষ করে অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি) নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারের সহায়তা লাগে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইং থেকে তারা এ তথ্য সংগ্রহ করে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির কাছ থেকে অন্য কোনো সংস্থার অধীনে নেয়া হলে সাংবিধানিক সংকটের সৃষ্টি হতে পারে । তারা বলেন, এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে হস্তান্তর হলে সংবিধানের ১১৯ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এনআইডি স্থানান্তরের নির্দেশ কমিশনের অঙ্গচ্ছেদের নামান্তর।

 

ভোরের আকাশ/নি

 

মন্তব্য

Beta version