-->

সংকট মোকাবিলায় জোর প্রস্তুতি সরকারের

মো. রেজাউর রহিম
সংকট মোকাবিলায় জোর প্রস্তুতি সরকারের

মো. রেজাউর রহিম: করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আগামী ২০২৩ সালের সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। আর বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও সরবরাহ সংকট পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য উৎপাদন ও মজুত বৃদ্ধির জোরালো পদক্ষেপও নিচ্ছে সরকার। এছাড়া রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়াতে বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানো, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশপাশি গম, তেল, মসলা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশি রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ক্রয় এবং অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্য আনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য বাজারে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতেও সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। আর সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় এবং দুর্ভিক্ষাবস্থা এড়াতে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব অনাবাদি ও পতিত জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য দেশবাসীর প্রতি বার বার আহবান জানিয়েছেন।

 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব এবং চীনের পণ্য সরবরাহ কমতে থাকা পরিস্থিতির কারণে ২০২৩ সালে সম্ভাব্য সংকটের শঙ্কা রয়েছে। তবে যে কোনো ধরনের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিশেষ করে খাদ্যসংকটে যেন দেশে মানুষের খাদ্য নিরপত্তা বিঘ্নিত না হয় এবং দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সরকার আগে থেকেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক এবং সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপে নেয়া হয়েছে। এছাড়া খাদ্য মজুত, আমদানি ও সরবরাহ ঠিক রাখতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর দেশের সব অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় এনে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় বিলাসী প্রকল্প না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া সাশ্রয়ের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ এবং মিতব্যয়ী হওয়ার ওপরও জোর দিয়েছে সরকার।

 

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার খাদ্য মজুতের ওপর বাড়তি জোর দিয়েছে। বিশেষ করে চাল-গম সরকারি উদ্যোগে খাদ্যশস্য আমদানির জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১১ লাখ টন চাল সরকারি উদ্যোগে আমদানি হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সরকারিভাবে রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। সেই অনুমতির প্রথম চালানে ৫২ হাজার টন গম নিয়ে রাশিয়া থেকে গত ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এছাড়া ইউক্রেন থেকে সরকারের আমদানি করা ৫২ হাজার ৫০০ টন গম গত ৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসে পৌঁছেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন থেকে এই প্রথম কোনো খাদ্যপণ্যের জাহাজ বাংলাদেশে পৌঁছাল। এছাড়া রাশিয়া থেকে গমের আরো চালান শিগগিরই চট্টগ্রামে বন্দরে আসবে বলে জানা গেছে।

 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সরকারি খাদ্য গুদামে গত ৯ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে গমের মজুতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ১৬ টন। উল্লেখ্য, গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। দেশে বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন গম দেশে উৎপাদিত হয়। চাহিদার অবশিষ্ট গম ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা, আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়। আর আমদানির বড় অংশ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আমদানি হয়ে থাকে।

 

খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সরকারিভাবে দেশে মাত্র ৫ লাখ টন গম আমদানি করা হয়। বাকি ৬০ লাখ টন গম বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, দেশে খাদ্যের কোনো অভাব নেই। জোর দিয়ে তিনি বলেন, দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে ও মজুত রয়েছে, তাতে দেশে দুর্ভিক্ষের কোনো আশঙ্কা নেই। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সামনে ইরি ও বোরো মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে সার সরবরাহ ও সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে এবং পর্যাপ্ত খাদ্য মজুতের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হচ্ছে। এদিকে সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে খাদ্য আমদানি বৃদ্ধিকল্পে আমদানির ক্ষেত্রে উৎসে কর ছাড়, দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশে দক্ষ জনবল প্রেরণ ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া দেশে চাল, গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য মজুত বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে পণ্যমূল্য সহনীয় অবস্থায় রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

 

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১৫ লাখ টন চাল আমদানি করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরাসরি সংশিষ্ট দেশের রপ্তানিকারকেদের কাছে থেকে পণ্য আনার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যাতে পণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত কম হয়। আর আমদানির ক্ষেত্রে উৎসে করসহ কর ও শুল্ক ব্যবস্থা সহজীকরণ করা হবে। যাতে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এটি করা যায়, সেজন্য এনবিআরকে এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

সূত্র জানায়, গত প্রায় ১ বছরে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে বেশকিছু নতুন ও দ্রæত বর্ধনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, এগুলো ইতোমধ্যে পরীক্ষিতও হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে আগামী এক থেকে তিন বছরের মধ্যে দেশে খাদ্য ও মাছসহ অন্য বেশকিছু খাদ্যপণ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভানা রয়েছে। আর রেমিট্যান্স বৃদ্ধিকল্পে বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ওপর জোর দিয়েছে সরকার। আর এটা করা সম্ভব হলে রেমিট্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় এবং পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে এখন থেকে প্রেরণকারীকে কোনো ফি দিতে হবে না। যে ব্যাংকে পাঠাবে সেই ব্যাংকই ফি বহন করবে। এছাড়া দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর ওপরও বাড়তি জোর দিয়েছে সরকার। আর এজন্য বিনিয়োগের শর্ত আরো শিথিল করার বিষয়েও কাজ চলছে বলে জানা গেছে। যাতে বিনিয়োগকারী শুধু বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পন্ন করতে পারেন। এছাড়া ৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তে বিডা অনুমোদন দিতে পারবে।

 

এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ৩ লাখ ৪২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির হার ৪.১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৫ শতাংশ (সাময়িক), বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার নির্ণয় করা হয়েছে। এ অর্থবছরে দেশে রপ্তানি বেড়েছে ৩৪.৩৮ শতাংশ। মোট রপ্তানির পরিমাণ ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৩.৪৪ বিলিয়ন ডলার। আর প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৯ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১ হাজার ৮৩৬টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৯২.৮০ শতাংশ।

 

উল্লেখ্য, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী জালানি সংকট ও খাদ্যশস্য সরববরাহ ও রপ্তানিতে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আর এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন অজুহাতে ও কারসাজির মাধ্যমে বেপরোয়াভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে ব্যাপকভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। আর অন্যদিকে সার্বিক বৈশি^ক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০২৩ সালকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য ‘সংকটময় বছর’ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।

 

তবে বিশ্লেষকদের মতে, পযাপ্ত কৃষি উৎপাদন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি যথাযথ সরবরবাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্ভাব্য সংকট এবং খাদ্যাভাবজনিত পরিস্থিতি এড়াতে পারে।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version