-->

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা বিতরণ কোম্পানিগুলোর

মো. রেজাউর রহিম
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা বিতরণ কোম্পানিগুলোর

মো. রেজাউর রহিম: এবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর এবার গ্রাহক পর্যায়েও বাড়ানোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। বিদ্যুৎ বিতরণকারী আরো ৫ কোম্পানিও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরির কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

 

অন্যদিকে, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দা পরিস্থিতিতে দেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়নো হলে অন্য সব পণ্যের দাম বাড়ারও ঝুঁকি রয়েছে। এমনিতেই দেশে পণ্যমূল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ রয়েছে চরম ভোগান্তিতে। এর ওপর বিদ্যুতর দাম বাড়লে মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকেও আর্থিক সহায়তা নিচ্ছে সরকার। এসব সংস্থা বারবার বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে।

 

উল্লেখ্য, গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয় বিইআরসি। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ২০ পয়সা, যা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। বিইআরসি অবশ্য এর আগে দাম বাড়ানোর আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ১৩ নভেম্বর আপিল করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বিইআরসি।

 

ওই দিনই বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এখনই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়বে না বলে জানিয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করতে হচ্ছে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ার বিষয়টি নির্ভর করবে মাঠপর্যায়ের তথ্যের ওপর। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

 

তবে এর পরই গ্রাহক পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তিনটি কোম্পানি। বিইআরসির কাছে গ্রাহক পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির লিখিত আবেদন করে পিডিবি। যদিও এর আগে বিইআরসি বলেছিল, পাইকারি পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধির সময় গ্রাহক পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে না। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) শিগগির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দিতে যাচ্ছে বলে কমিশন সূত্র জানা গেছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে। তবে দু-একটি কোম্পানি এর বেশি মূল্যবৃদ্ধির আবেদনও করতে পারে। তাদের যুক্তি, পাইকারিতে বেশি দামে কিনে কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ কম দামে বিক্রি করতে পারবে না।

 

ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করে বলেন, আমরা ২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। উল্লেখ্য, খুলনা-বরিশালসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে এ কোম্পানিটি।

 

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে আমাদের লোকসান গুনতে হবে। যে কারণে দাম বাড়ানোর আবেদন করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নেয়া হবে।

 

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ডিপিডিসির আওতাভুক্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে।

 

বিইআরসি সদস্য বজলুর রহমান জানান, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে পরে গণশুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হবে। গণশুনানির পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

 

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ভোরের আকাশকে বলেন, পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে প্রথমে বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে, এখন বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। তিনি বলেন, পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর সময় প্রথমে বলা হয়, গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে না এবং দাম বাড়ানো হবে না। পরে বিতরণ কোম্পানির আবদারে খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানো হয়Ñ যা দেশের মানুষের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা। এ ছাড়া বিষয়টি সম্পূর্ণ অনৈতিক ও আইনের পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

এদিকে গত জুন মাসে গ্যাসের মূল্য ও আগস্টে জ্বালানির দাম বাড়ানোর পর থেকেই দেশের বাজারে সব পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ছে। আর এ জন্যই দেশের মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ায়নি সরকার। তবে এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংকেত নিয়েই বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তৎপরতা করছে বলে জানা গেছে। আর বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর অজুহাতে ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়াবেন বলে আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা, যা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো দুর্বিষহ করে তুলবে বলে মনে করেন তারা।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version