-->
শিরোনাম
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস আজ

প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সম্পৃক্ত না করায় জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব

শাহীন রহমান
প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সম্পৃক্ত না করায় জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব

শাহীন রহমান: প্রতিবন্ধী মানুষকে বিকাশ ও কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত না করায় জিডিপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেশের প্রতিবন্ধিকতা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সম্পৃক্ত না করার ফলে দেশজ উৎপাদনের ১ দশমিক ৭৪ ভাগ সমপরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাঠামোগত বাধা রয়েছে। ফলে তারা সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধীদের, বিশেষত প্রতিবন্ধী নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি। সব ধরনের গণস্থাপনায় সর্বজনীন নির্মাণ নকশা অনুসারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সবার জন্য প্রবেশগম্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সব ধরনের তথ্য-প্রযুক্তিগত কন্টেন্ট, সব ই-সেবা, ওয়েবসাইট, স্মার্টফোনে ব্যবহৃত অ্যাপ্লিকেশন সবার জন্য ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করা।

 

আজ শনিবার দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধীরা সুবিধাবঞ্চিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না বললেই চলে। সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে নানা অবহেলার শিকার। তাদের বিকাশ ও কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করা গেলে বোঝা না হয়ে দেশের উন্নয়নে যথাযথ ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম হবে।

 

দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা নিয়ে আজো বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা নির্ধারণে রয়েছে নানা সমস্যা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত খানা জরিপে দেখা যায়, এ হার ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গত বছর একটি জরিপ চালানো হয়েছে।

 

চলমান ‘প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ এই জরিপে’ (৮ ডিসেম্বর ২০২১) পর্যন্ত মাত্র ২৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৩ জন প্রতিবন্ধী মানুষ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন-২০১১’-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ দশমিক ৬ ভাগ প্রতিবন্ধী। যাদের ৮০ শতাংশ মানুষ উন্নয়নশীল দেশে বাস করে।

 

প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কাজ করার বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেশে প্রতিবন্ধী রয়েছে শতকরা ১০ শতাংশ। তবে সংখ্যা যাই হোক, নানা বাধা পেরিয়েও যারা শিক্ষার গন্ডি সমাপ্ত করছে, কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে আবারো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

 

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদের যুগ্ম আহব্বায়ক আলিফ হোসেন বলেন, দেশে ২ হাজার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রয়েছে যারা বিভিন্ন কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু চাকেিত প্রবেশের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে শ্রুতি লেখকের প্রয়োজন হয়। ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত পিএসসির পরীক্ষায় পছন্দ অনুযায়ী শ্রুতি লেখক বাছাই করা যেত। কিন্তু এরপর থেকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্রুতি লেখক ঠিক করে দিচ্ছে। ফলে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নানা সমস্যার সম্মুীন হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, পিএসসির পরীক্ষায় চতুর্থ শ্রেণির একজন পিয়ন শ্রুতি লেখক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু তারা উচ্চারণ ঠিকমতো করতে পারে না। আবার প্রশ্ন ঠিকমতো বুঝে উচ্চারণ করতে পারে না। ফলে এক ঘণ্টার পরীক্ষায় প্রশ্ন বুঝতেই সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কীভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

 

এ কারণে শিক্ষিত হয়েও অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চাকরি পাচ্ছে না। বেকার জীবনের অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে।

 

এ ছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগ পরীক্ষায় ২০১৮ সাল থেকে কোটা বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের বিশেষ ব্যবস্থার কথা বললেও আজো সে ব্যবস্থা কী জানতে পারিনি।

 

তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের মানসিক বিকাশ ও উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় অভিন্ন শ্রুতি লেখক নীতিমালা প্রণয়ন, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ৮৫০ টাকা হতে ন্যূনতম ৫০০০ টাকায় উন্নীত করতে হবে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাধা শুধু শিক্ষিত প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে নয়। নানা সমস্যার কারণে প্রতিবন্ধী শিশুরা কাক্সিক্ষত মাত্রায় শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হলো যাতায়াতের সমস্যা, সমাজ ও পরিবারের অসচেতনতা, প্রণোদনা ও সহায়ক উপকরণের অভাব এবং শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা।

 

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাউসার আহাম্মদ সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বলেন, তাদের প্রতি সহমর্মিতা এবং সবক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধিতা নিয়ে সচেতনতার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার এবং শিক্ষকদের ইশারা ভাষা শেখার প্রতি জোর দেন।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত ২ দশকে সার্বিকভাবে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের পরিসংখ্যানগত অবস্থান বিবেচনায় কাক্সিক্ষত ফলাফল এখনো অর্জিত হয়নি। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকাংশই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না।

 

সাধারণ সজ্ঞায় বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আর দশজন যে কাজগুলো করতে পারে, ইমপেয়ারমেন্টের (বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন) কারণে সে কাজগুলো প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থাটাই হলো ডিসঅ্যাবিলিটি বা প্রতিবন্ধিতা।

 

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষা অনুযায়ী ইমপেয়ারমেন্ট হলো দেহের কোনো অংশ বা তন্ত্র যদি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়, সে অবস্থাটিকেই প্রতিবন্ধিকতা বোঝায়। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন, ২০০১-এ বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী অর্থ এমন এক ব্যক্তি, যিনি জন্মগতভাবে বা রোগাক্রান্ত হয়ে বা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসায় বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং উক্তরূপ বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম।

 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাদের প্রতিবন্ধকতা বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারা যায় না। বিভিন্ন প্রকার দীর্ঘমেয়াদি অসুখ, মানসিক রোগ, অটিজম, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, অ্যাটেনশন ডেফিশিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার, বুদ্ধি-প্রতিবন্ধতা এই শ্রেণির মধ্যে পড়ে।

 

এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা দৈনন্দিন জীবনে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। যেমন সামাজিক নিয়মকে বুঝতে পারা, সামাজিক মেলামেশা, মনঃসংযোগ, রাস্তা চিনতে পারা, নিজেকে নিরাপদ রাখা, কোথায় কোন কথা কতটুকু বলা উচিত তার বোধ ইত্যাদিতে ঘাটতি থাকতে পারে। যেহেতু বাইরে থেকে এই প্রতিবন্ধকতা দেখা যায় না, তাই লোকজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে অলস বা নিশ্চেষ্ট ভেবে দুর্ব্যবহার করে থাকেন।

 

এ ছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তি নানা ধরনের নির্যাতন এবং বঞ্চনার শিকার হয়। এ কারণে সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। ব্যাপক হারে তাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সম্পৃক্ত করা না গেলে দেশে জিডিপিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে বাধ্য।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version