-->
শিরোনাম
স্বাধীনতার ৫১ বছর

আলোকিত মানুষে ভরেছে দেশ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
আলোকিত মানুষে ভরেছে দেশ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ‘চক্ষু থাকিতে অন্ধ যাহারা আলোকের দুনিয়ায়/ সিন্ধু সেচিয়া বিষ পায় তারা অমৃত নাহি পায়।’ যাদের চোখে আলো নেই তারা আলোকের পৃথিবী দেখতে পান না। এক জীবন কেটে যায় পৃথিবীর আলো দেখার প্রত্যাশায়। কিন্তু ফল পান না। তেমনি যাদের শিক্ষা নেই, তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। ঠিক তেমনি অবস্থা ছিল বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের। স্বাধীনতার আগে গ্রামে শিক্ষিত লোক খুঁজতে হতো।

 

ডাক পিয়ন চিঠি দিয়ে গেলে কে পড়বে তা নিয়ে দ্ব›েদ্ব পড়ে যেতেন গ্রাহক। স্বাধীনতার পর সেই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসে আলোকিত মানুষে ভরেছে দেশ। এখন বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ চারভাগের তিন ভাগ মানুষ পড়তে ও লিখতে পারেন।

 

প্রাপ্ত তথ্যমতে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের বেশি। আর ৫১ বছর পর এসে এখন দেশে সাক্ষরতার হার হয়েছে ৭৫ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ এইসংখ্যক মানুষ পড়তে ও লিখতে পারে।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের নারী-পুরুষ মিলে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যার মধ্যে অঞ্চলভেদে গ্রামাঞ্চলে ৭১ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ। দেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ। অন্যদিকে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

 

আলোকিত মানুষ গড়তে অন্যান্য বছরের মতো ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ বছরই শিক্ষা খাতে ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এ অর্থবছরে শিক্ষায় ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। আগের অর্থবছরে যার বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। একইভাবে দেশে আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার জন্য বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ রাখা হয় ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা।

 

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। একই মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে যা ছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

 

এদিকে শিক্ষার এই অগ্রগতি নিয়ে কথা বললে শিক্ষায় সরকারের আন্তরিকতার কথা বলেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে আজমল আলী নামে এক প্রবীণ ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের ছেলেবেলায় সব এলাকাতেই শিক্ষিত লোক কম ছিল। কোনো কোনো গ্রামে দু-একজন মেট্রিক পাস লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। দলিল পড়তে হলেও খুঁজতে হতো পড়তে জানা মানুষ। তখন লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। সরকার এখন অনেক সুযোগ দিয়েছে। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। সব মিলে দিন দিন বাড়ছে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা। এটা খুব ভালো খবর।

 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষার হার বেড়েছে ২০০৭ সালের পর। শিক্ষার হার ২০০৭ সালে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে শিক্ষার হার বেড়েছে ২৮ শতাংশ। শিক্ষাকে আরো এগিয়ে নিতে ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ৪০০ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯১১ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। বিনামূল্যে বই বিতরণের পাশপাশি বিভিন্ন ধরনের মেধাবৃত্তি, উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার হার বাড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে নিরাক্ষরমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর ভোরের আকাশকে বলেন, শিক্ষায় এ সফলতা এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও শিক্ষার উন্নয়নে বড় ভ‚মিকা রাখছেন। সব মিলে দেশ শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের মানুষ যখন শিক্ষিত হয়ে ওঠে, তখন সেই দেশের প্রতিটি সেক্টরে পরিবর্তন আসে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ শিক্ষিত হয়ে ওঠে।

 

এদিকে স্বাধীনতার পর বেড়েছে উচ্চশিক্ষার হারও। এই সময়ে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় সবই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। স্বাধীনতার পর দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ছয়টি। আর এখন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে ১৫৮টি। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হাতেগোনা কিছুসংখ্যক বাদে বেশির ভাগের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ২০২০ সালে দেশের ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৭টি গবেষণা খাতে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি।

 

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভর্তির হার, পাসের হার, ঝরে পড়া রোধ, ছাত্র-ছাত্রীর সমতা, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়া থেকে শুরু করে সংখ্যাগত দিক দিয়ে শিক্ষার অর্জন ও উন্নতি দৃশ্যমান। তবে সংখ্যায় ব্যাপক উন্নতি থাকলেও শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রশ্ন আছে।

 

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইসের) সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকসের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৭ হাজার ৭৯১টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হয়েছে ২০ হাজার ৮৪৯টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী হয়েছে এক কোটির বেশি। ১৯৭২ সালে কলেজ ছিল ৫২৬টি। আর এখন হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৯টি। এখন শিক্ষার্থী হয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ। এ ছাড়া দেশে আলিয়া ও দাখিল মাদরাসা আছে ৯,৩০৫টি।

 

এদিকে বর্তমানে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশে। অথচ ২০০৫ সালেও প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এখন সারা দেশে সরকারি, বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজারের বেশি। এসব উন্নয়নের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রেই উন্নয়ন হয়েছে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

 

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যেসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন খুব বেশি দৃশ্যমান, তার মধ্যে শিক্ষা খাত একটি। শিক্ষার এই সাফল্য অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version