-->
বদলে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্য

উষ্ণ হচ্ছে শীতকাল, বর্ষায় বাড়ছে আর্দ্রতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
উষ্ণ হচ্ছে শীতকাল, বর্ষায় বাড়ছে আর্দ্রতা

শাহীন রহমান: শীতকালে জাঁকিয়ে শীত নামবে। গরমকালে প্রচণ্ড গরম। এটাই স্বাভাবিক। আবহমানকাল থেকেই বাংলার প্রকৃতিতে ছয় ঋতু বিদ্যমান। যার ধরন ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। তবে সাম্প্রতিককালে ঋতুবৈচিত্র্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। ফলে বদলে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্য। শীতে কাক্সিক্ষত শীত পাওয়া যায় না।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শীত ঋতুর ওপর। ফলে ক্রমেই উষ্ণ হয়ে পড়ছে শীতকাল। এ ছাড়া একই কারণে বর্ষা ঋতুতে আর্দ্রতা বাড়ছে। ফলে হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও অকাল বন্যার মতো ঘটনাও ঘটছে দেশে।

 

প্রকৃতিতে পৌষ ঋতু শুরু হচ্ছে এক দিন পরেই। তবে এখনো কাক্সিক্ষত শীতের দেখা মিলছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে শীতকাল এমন ছিল না। শীত ঋতু শুরু হওয়ার অনেক আগেই গ্রামবাংলায় শীতের আমেজ পাওয়া যেত। পৌষ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা জাঁকিয়ে নামত। টানা প্রায় ৩ মাস এখানে শীতের অনুভূতি পাওয়া যেত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন বদলে যাচ্ছে। এখন ঋতু ধরে আর শীত আসছে না। আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরতলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগও বেড়ে যাচ্ছে। শীতকালে এর প্রভাব পড়ছে বেশি। তিনি বলেন, শীতকালে সঠিক সময়ে শীত না নামার কারণ হলো এই সময়ে সাগরে ঘন ঘন লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়া। লঘুচাপ সৃষ্টি হলে বাতাসে জলীয় বাষ্প ও আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি উত্তরের হিমেল হাওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ কারণে ডিসেম্বর মাসেও কাক্সিক্ষত শীতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

 

জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে উষ্ণতা বাড়ছে- তার একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা সিইজিআইএসে। এতে দেখানো হয়েছে, ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সালে প্রতিবছর গড়ে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.০০৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ১৯৯১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ আগের তিন দশকের তুলনায় গত তিন দশকে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে এর প্রায় সাড়ে চার গুণ।

 

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের ওপর।

 

উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকরা বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশ ৭ম সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।

 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম হোক আর সপ্তম স্থানে হোক, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে যে ঝুঁকি বাড়ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিন দশকে দেশের তাপমাত্রা বেড়েছে দ্রুত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলছে, তাপমাত্রা বাড়ার প্রভাবই বেশি পড়ছে শীত ও বর্ষা ঋতুর ওপর। এ কারণে শীতকাল আরো বেশি শুষ্ক এবং বর্ষাকাল আরো বেশি আর্দ্র হচ্ছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিন দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা তার আগের তিন দশকের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে।

 

সিইজিআইএসের হিসাবে আরো দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০০০-এর মধ্যে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বেড়েছে বছরে গড়ে ০.৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ে ১.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীত ও বর্ষায় সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে বছরে বেড়েছে ০.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ০.৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে শীতকাল ক্রমে উষ্ণতর হচ্ছে। একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যাচ্ছে। দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গড়ে ৮.৪ মিলিমিটার বেড়েছে। শীতকালে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং মার্চ থেকে মে মাসে বৃষ্টিপাত বছরে কিছুটা কমেছে।

 

অন্যদিকে, বর্ষা ও বর্ষার পর জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। এর অর্থ শীতকাল আরো বেশি শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুম আরো বেশি আর্দ্র হচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এ বছর জাতিসংঘ থেকে আশঙ্কা করা হয়েছে, এই শতকে বিশ্বজুড়ে গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির বেশি বাড়লে বিশ্বে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল আইপিসিসির প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে দেশে অতিবৃষ্টির হার, শক্তিশালী সাইক্লোনের হার ক্রমেই বাড়ছে। এতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতি দশকে এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে প্রচণ্ড খরায় অধিকাংশ জমি শুকিয়ে যাবে। জমি উর্বরতা হারাবে। হিট ওয়েভ বা তাপপ্রবাহের ঘটনা এরই মধ্যে বেড়েছে ২.৮ গুণ। বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সালিমুল হক বলেন, আইপিসিসির প্রতিবেদনে এটি পরিষ্কার যে, মানবসৃষ্ট কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছি। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। বেড়েছে দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version