-->

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে জনদুর্ভোগ বাড়বে

মো. রেজাউর রহিম
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে জনদুর্ভোগ বাড়বে

মো. রেজাউর রহিম: গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হবে না বলা হলেও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ইউনিট প্রতি এক টাকা ২১ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি গত বছরের ফেব্রুয়ারীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জ্বালানী ও অর্থনৈতিক সংকটের অজুহাতে দেশে সব পণ্যের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে।

 

গত বছর পুরোটাই পণ্যের দাম বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে এবং দাম বাড়তে বাড়তে প্রায় সব পণ্যের দামই এখন আকাশচুম্বী। এই অবস্থায় নতুন করে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসি। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বার্থ বিবেচনা না করে বিদ্যুতের বর্তমান খুচরা মূল্য ইউনিট প্রতি ৭ টাকা ০২ পয়সা থেকে এক টাকা ১৯ পয়সা বাড়িয়ে তা ৮ টাকা ২৩ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে পণ্যের উৎপাদন ও মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে যা মানুষকে আরো ভোগান্তিতে ফেলবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

রোববার বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির পর বিইআরসির কারিগরি কমিটি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করে। বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ও চারজন সদস্য এ শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।

 

এর আগে গত ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে বিইআরসি। তবে বিইআরসি তখন বলেছিল, এতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়বে না। আর তখন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছিলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কিনা তা বিইআরসি নির্ধারণ করবে। আর গ্রাহক পর্যায়ে যাতে স্বস্তি থাকে, সে বিষয়টি আমরা বিবেচনা করব। আর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের যে দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা গ্রাহক পর্যায়ের জন্য নয় বলেও তখন উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

 

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) দেশে বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা। বিপিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহক বা খুচরা পর্যায়ে বিতরণ করে দেশের পাঁচটি কোম্পানি। এগুলো হলো ডেসকো, ডিপিডিসি, আরইবি, নেসকো ও ওজোপাডিকো। এ ছাড়া বিপিডিবি পাইকারির পাশাপাশি দেশের কিছু এলাকায় সরাসরিও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। আর বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো বর্তমানে মুনাফায় থাকায় পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লেও বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর জন্য তা খুব বড় সমস্যা নয়।

 

জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা দাম একসঙ্গে বাড়ানো হয়। তখন পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। আর খুচরা পর্যায়ে দাম ৫ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অবশ্য গ্রাহককে এ দামের সঙ্গে ভ্যাট, সার্ভিস চার্জসহ আরো বাড়তি দাম পেিরশোধ করতে হচ্ছে।

 

বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। তবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানী তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দাম কিছুটা সমন্বয় করা হতে পারে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামের বিষয়ে যাচাই-বাছাই চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জ্বালানী ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বেড়েছে। আর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টি বিইআরসি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে।

 

এদিকে, গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সরকার যেকোনো সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে পারবে এমন বিধান যুক্ত করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০২৩-এর খসড়ার চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আইনটি অনুমোদনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, আইনটি সংসদে পাস হলে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির দাম পুনর্নির্ধারণ বা সমন্বয় করতে পারবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পাশাপাশি সরকার নিজেও এগুলোর দাম বাড়াতে-কমাতে পারবে।

 

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, বিদ্যমান আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বিইআরসি ৯০ দিন সময় নিয়ে নির্ধারণ করে। বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারও যেন তা নির্ধারণ করতে পারে এজন্যই প্রস্তাবিত এ সংশোধনী মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই এটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

উল্লেখ্য, এর আগে গত নভেম্বরে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বিইআরসি। এরপর থেকেই খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন জমা দিতে থাকে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো। সেই আবেদন কারিগরি কমিটিতে মূল্যায়ন শেষে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ভর্তুকি কমাতে গত ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি। আর বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করছে ৬ টাকা ২০ পয়সা, যা আগে ৫ টাকা ১৭ পয়সা ছিল।

 

গত এক যুগে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সবশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে, সে সময় বিদ্যুতের দাম পাইকারি ও গ্রাহক এই দুই পর্যায়েই বাড়ানো হয়, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বেড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা হয়, যে হার এখনো বহাল।

 

এদিকে, বর্তমানে এমনিতেই দেশের মানুষ নিত্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে। সাংসারিক ব্যয় সামলাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অস্বস্তিকর ও জনগণের জন্য বাড়তি ভোগান্তি সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম ভোরের আকাশকে বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি আরো তীব্র আকার ধারণের আশঙ্কা রয়েছে, যা জনগণের জন্য বাড়তি ভোগান্তি সৃষ্টি করবে।

 

তিনি বলেন, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে পণ্যমূল্য আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হলে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ আরো বাড়ার পাশাপাশি জনভোগান্তি সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতের সিস্টেম লস, অপচয় এবং অনিয়ম বন্ধে সরকারকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।

 

বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচসহ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়বে, যা বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপবে। এজন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না এবং এ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

 

মন্তব্য

Beta version