শাহীন রহমান: একনেকে না ওঠায় দেড়শ আসনে ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশনের। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১১ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হলেও ইভিএম কেনার প্রকল্পটি সভায় ওঠেনি। আগামী সভায় এ প্রকল্প উঠবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়।
জানা গেছে, প্রকল্পটি নিয়ে মূল্যায়ন কমিটির সভাই হয়নি। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্তটা অনেকটাই ঝুলে গেল।
ইসির পক্ষ থেকে আগাগোড়াই বলা হচ্ছে, ১৫ জানুয়ারি মধ্যে প্রকল্প পাস না হলে আগামী নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট নেয়া সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যালটেই প্রস্তুতি নিতে হবে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন ইসি রাশিদা সুলতানা।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য পকিল্পনা কমিশনের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু প্রকল্পে অগ্রগতি না থাকায় ইভিএম নিয়ে এখন আর আশাবাদী হতে পারছে না ইসি। ইভিএমে নতুন প্রকল্প মধ্য জানুয়ারিতে পাস না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালটে করতে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। সে প্রকল্প খুব একটা এগোচ্ছে বলে মনে হয় না।
এদিকে মঙ্গলবার একনেকের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তবে তিনি প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, একেনেকের সভায় ইভিএম প্রকল্পটি কার্যতালিকায় ছিল না। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে কিছু জানতে চাননি। আমরা নিজ থেকেও কিছু বলিনি।
ইভিএম মেশিন কেনার প্রকল্পটি নিয়ে গত সপ্তাহে হঠাৎ করে তড়িঘড়ি শুরু করে সরকার। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগও প্রকল্পটি নিয়ে কাজ শুরু করে। ধারণা করা হয়েছিল, কার্যতালিকার বাইরে এ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের আগে অবশ্যই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করতে হয়। যেখানে প্রকল্পের ওপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। কিন্তু ইভিএম প্রকল্পে এখন পর্যন্ত পিইসির সভাই হয়নি। পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এটা আইন অনুযায়ী প্রক্রিয়াধীন। যদি এটা অনুমোদন না হয়, তবে সংশ্লিষ্টরা দেখবেন। এটা আমার আওতায় নেই।
নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় গত ১৯ অক্টোবর। প্রকল্পটির নাম ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’। প্রকল্পের পুরো টাকা সরকার জোগান দেবে। তবে জানা গেছে, বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকলেও নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাজনৈতিক বিতর্কের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ইভিএম কেনা ও এর পেছনে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
মঙ্গলবার একনেক সভায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধনের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। এদিন মোট ১১টি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। ১১টি প্রকল্পের ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড়শ (সর্বোচ্চ) আসনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে হাতে থাকা ইভিএম দিয়ে ৬০-৭০টি আসনে ভোট করার সক্ষমতা থাকায় নতুন করে ইভিএম সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
এর অংশ হিসেবে গত সেপ্টেম্বর মাসে কমিশন সভায় দুই লাখ নতুন ইভিএম কেনাসহ তা রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণের জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
প্রকল্পে ইভিএমপ্রতি দাম ধরা হয় ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৫৩৪টি গাড়ি, ১০টি গুদাম তৈরি ও এক হাজারের মতো লোকবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্প গত ২০ অক্টোবর সরকারের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে গত ৮ নভেম্বর সেই প্রস্তাব ইসিতে ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন।
পর্যবেক্ষণে কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোসহ ফিজিবিলিটি স্টাডির কথা বলে পরিকল্পনা কমিশন। ইসি জানায়, যেহেতু তারা আগে থেকেই ইভিএম ব্যবহার করছে, তাই একই যন্ত্রের ওপর ফিজিবিলিটি স্টাডির প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ নিয়েই প্রস্তাবটি ফের পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে ইসি ও পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি শেষে পরিকল্পনা কমিশনের শর্ত পূরণ করে গত ১১ জানুয়ারি পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাব আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
তবে আশা করা হয়েছিল, এজেন্ডায় না থাকলেও মঙ্গলবারের একনেকের সভায় বিষয়টি ওঠানো হতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিষয় এজেন্ডায় না থাকলেও টেবিলে উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। কমিশন চাইলে যেকোনো প্রকল্প বৈঠকের টেবিলে তুলতে পারে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একনেক বৈঠকে সম্পূরক এজেন্ডা হিসেবে টেবিলে ইভিএম প্রকল্প উঠবে এটাই আশা করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইভিএম প্রকল্প একনেকে না ওঠায় ইভিএমে ভোটগ্রহণের আশা প্রায় ফিকে হতে চলেছে ইসির।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য