ইমরান আলী : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরই বিভিন্ন পর্যায়ের ২৭২ কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এদের মধ্যে গ্রেপ্তারের ভয়ে ৪৪ জন বিদেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। পাশাপাশি ৩০টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্বর্ণের চালান আসে। এর মধ্যে ৭টি বিদেশি সিন্ডিকেট। আর ১১টি সিন্ডিকেট শাহজালালকে ঘিরেই। দেশে আসা স্বর্ণগুলো ভারতে পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় বেনাপোল স্থলবন্দর। সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পর কাস্টমস, কাস্টমস গোয়েন্দা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, স্বর্ণ চোরাকারবারিদের গ্রেপ্তারে আমরা কাজ করছি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট এ নিয়ে কাজও করে। পূর্বে স্বর্ণ চোরাকারবারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গ্রেপ্তারও হয়েছে।
জড়িত বিমানের কর্মকর্তারা : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ৫ জন পাইলট, ৪ জন কো-পাইলট, ২৫ জন কেবিন ক্রু, ১৫ জন ফ্লাইট স্টুয়ার্ড, ৩ জন ফ্লাইট পার্সার ও ৫ জন চিফ পার্সারসহ মোট ২৭২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বর্ণ পাচারে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিমান বাংলাদেশের মোট ৪৪ জন সদস্য বিদেশে আত্মগোপন করে আছে। কয়েক বছর আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার হয়েছিল।
৩০ সিন্ডিকেটের ৭টি বিদেশি, শাহজালালকে ঘিরে ১১ : দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৩০টি সিন্ডিকেট স্বর্ণ পাচার করে থাকে। এর মধ্যে ৭টি বিদেশি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশের ২৩টি সিন্ডিকেটের মধ্যে ১১টি সরাসরি আর ১২টি মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে। ১১টি দেশি সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরেই রয়েছে ৭টি। বাকি ৪টির মধ্যে ৩টি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ও ১টি রয়েছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরকে ঘিরে। এসব সিন্ডিকেটের মূল হোতারা দেশের বাইরে অবস্থান করছে। কিছু দেশীয় সিন্ডিকেট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় স্বর্ণের চালান বিমানবন্দর থেকে পার করে দেয়। আর এর বিনিময়ে মাসিক অথবা প্রতিবার উৎকোচ গ্রহণ করে।
প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে স্বর্ণ পাচার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- আলামিন মানি এক্সচেঞ্জ, ফারহান মানি এক্সচেঞ্জ, অনিক মানি এক্সচেঞ্জ, ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জ, প্যারামাউন্ট মানি এক্সচেঞ্জ ও জাকির মানি এক্সচেঞ্জ। এর মধ্যে ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক হারুনুর রশিদ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একবার আটকও হয়েছিল।
বিদেশি যেসব মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে, এর মধ্যে হলো আলামিন মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মামুন আল আজাদ ওরফে সুমন। দই বছর আগে বিদেশি অর্থসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে জামিন নিয়ে সে দুবাই অবস্থান করছে। দুবাইয়ে শফিউল আজম পিন্টু নামের আরেক ব্যক্তি বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই স্বর্ণ পাচার করে থাকে। দুবাইয়ের এমরান মানি এক্সচেঞ্জ। মালিক এমরান হোসেন স্বর্ণ চোরাচালানের একজন গডফাদার হিসেবে পরিচিত। দুবাই থেকে যেসব স্বর্ণ দেশে আসে, তার অধিকাংশই তিনি পাচার করে থাকেন। আর সব লেনদেনের হিসাব-নিকাশ ও হয় তার প্রতিষ্ঠান থেকে। দেশে যে ১১টি স্বর্ণের সরাসরি সিন্ডিকেট রয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই চট্টগ্রামে থাকে।
স্বর্ণ চোরাচালান প্রক্রিয়া : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে স্বর্ণের অবৈধ চালানের একটি বড় অংশ আসে দুবাই থেকে। ক্ষুদ্র চালানগুলো বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় অসাধু ব্যক্তির সহায়তায় বিমানবন্দরের বাইরে চলে আসে। এছাড়া বৃহৎ চালানগুলো পাচারে বিমানকে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে স্বর্ণ বহনকারী ব্যক্তি বিমানের সিট অথবা টয়লেটে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করে। পরে বিমানের কতিপয় অসাধু ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে সে স্থান থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করে বাইরে বের করে দেয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানগুলো বিমানবন্দরে অধিক সময় অবস্থানের কারণে বিমানবন্দর-সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিরা বিমান থেকে অবৈধ স্বর্ণ সংগ্রহে বেশি সময় পায়। পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বর্ণের বড় চালান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন ফ্লাইটে আসে। একটি বড় স্বর্ণের চালানের সঙ্গে একাধিক সিন্ডিকেট জড়িত থাকে। এরা এদেশে পাচারকৃত স্বর্ণ সংগ্রহ করে পরে ভারতে পাচার করে দেয়। জড়িত সিন্ডিকেটগুলো স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য স্বর্ণগুলো দেশের বা বিদেশের বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় বা লেনদেন হয়ে থাকে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, স্বর্ণ চোরাচালানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এদেশ থেকে দুবাই বা অন্যান্য দেশে যাওয়া বিভিন্ন বিমান সংস্থার পাইলট, কো-পাইলট, কেবিন ক্রু, স্টুয়ার্ডসহ বিভিন্ন ব্যক্তি। বিমানবন্দরে এসব ব্যক্তির চেকিং ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সময় এরা চোরাকারবারিদের দেয়া প্রচুর অর্থ বহন করে নিয়ে যায়।
ভারতে পাচারের নিরাপদ রুট বেনাপোল ও ভোমরা : গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে স্বর্ণ চোরাচালান ধরা পড়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চোরাচালানিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে এক সিন্ডিকেট অপর সিন্ডিকেটের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বা বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমস ও কাস্টমস গোয়েন্দাদের আগেই খবর দিয়ে দেয়। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিমানবন্দরে নিযুক্ত বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার অভাব। এক্ষেত্রে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী ভাগবাটোয়ারা কমবেশিতে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের তথ্য ফাঁস করে দেয়। তৃতীয় ও সর্বশেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাচারকারীদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া। এক্ষেত্রে উৎকোচ কমবেশি হওয়ার কারণেও তথ্য ফাঁস করে দেয়।
বিমানবন্দরে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণের ট্যাক্স একসময় কম ছিল বলে সে সময় চোরাকারবারিরা রেন্ট-এ ক্রাউড পদ্ধতিতে স্বর্ণ নিয়ে আসত। অর্থাৎ দুবাই, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া থেকে ৪০ জন যাত্রী ভাড়া করল। এক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেককে একটি করে বার দিয়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে শাহজালালে এসে সেগুলোর ট্যাক্স দিয়ে পরবর্তী সময়ে নিয়ে নিত। পরে স্বর্ণের ট্যাক্স বাড়ার ফলে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনার প্রবণতা বেড়ে যায়। চোরাকারবারিরা বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে চোরাচালান করতে থাকে। কিন্তু যখন বনিবনা হয় না, এ সময় ধরা পড়ে এ কথা সত্য। এছাড়াও বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এখন অনেক বেশি আন্তরিক।
তিনি বলেন, এ পদ্ধতি ছাড়াও চোরাকারবারিরা বিমানের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বিমানের ভেতরে করে বড় বড় স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে আসার ঘটনা রয়েছে। তবে বর্তমানে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের কারণে স্বর্ণ ধরা পড়ার ঘটনা বেশি। ভারতে স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাকারবারিরা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণের চালানগুলো দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী হয়ে দেশে প্রবেশ করে। পরে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ করে সেগুলো বাইরে নিয়ে আসা হয়। এরপর সেগুলো বিশেষ করে বেনাপোল ও ভোমরা সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে যায়।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য