নিখিল মানখিন: আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে বলে রোববার জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কয়েক মাস ধরে রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার আলোচনায় ডজনের বেশি ব্যক্তির নাম থাকলেও গত দুই সপ্তাহে তালিকা সংক্ষিপ্ত হয়ে এখন দুজনে নেমে এসেছে। আলোচনার শীর্ষ দুইয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রোববার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত কমিশনের বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২৩ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্পিকারের সঙ্গে সিইসির বৈঠকের তারিখ ঠিক করব বলে জানান জাহাঙ্গীর আলম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ গ্রহণ করেন। আগামী ২৩ এপ্রিল তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান নেই। ফলে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের তৃতীয় মেয়াদে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় পরবর্তী রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগ থেকে হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত। পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়ে আলোচনার তালিকায় অনেকজনের নাম থাকলেও গত কয়েক সপ্তাহে তা সংক্ষিপ্ত হয়ে দুজনে নেমে এসেছে। অন্য সব ব্যক্তির নাম আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত ঘোষণার আগ পর্যন্ত পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন তা জানার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর, সর্বোচ্চ সীমা উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে। তবে তার সংসদ সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তফসিল ঘোষণার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অবশ্য জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন।
১৯৯১ সালের রাষ্ট্রপতি আইন অনুসারে, ইসি ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে এবং যাচাই-বাছাই করবে মনোনয়নপত্র। প্রার্থী একজন হলে এবং যাচাইয়ে তার মনোনয়নপত্র বৈধ বিবেচিত হলে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করবে ইসি। একাধিক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হলে ভোট হবে। সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্তকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আর সমান ভোট পেলে প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে ফল নির্ধারণ করা হবে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ মোট আসন ৩৫০টি। আওয়ামী লীগের মোট আসন ৩০২টি, জাতীয় পার্টির ২৬টি, ওয়ার্কার্স পার্টির ৪টি, জাসদের ২টি, গণফোরামের ২টি, বিকল্পধারার ২টি, তরিকত ফেডারেশনের ১টি ও জেপির ১টি আসন রয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রয়েছেন তিনজন। বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করায় এখন সংসদে দলটির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, তফসিল ঘোষণা না হওয়ার কারণে পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি পদে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত আলোচনার মধ্যেই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে কারা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন, তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। যেসব নাম নিয়ে দলে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে, সেগুলো খসড়া বলা চলে। চূড়ান্ত একজনকে বাছাই করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এখনো নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করেননি। তবে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের আলাপ-আলোচনায় পরবর্তী রাষ্ট্রপতির তালিকায় বিভিন্ন সেক্টরের অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নাম উঠে এসেছে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে কে আসতে পারেন, এ বিষয়ে কাজ করছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি করা হবে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে জানান আবদুর রাজ্জাক।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী বড় রাজনৈতিক দল। এই দলে রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত ঘোষণার আগ পর্যন্ত পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন তা জানার সুযোগ নেই। তবে মিডিয়ার মাধ্যমে আমিও অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তির নাম দেখতে পাচ্ছি বলে জানান সুজিত রায় নন্দী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের আলোচনায় শীর্ষে আছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির অত্যন্ত আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি ইআরডি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করলেও তাকে অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকে তিনি এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার জন্য তিনি বিশ্বব্যাংকের কড়া সমালোচনা করেন। পরে কানাডার আদালতে দুর্নীতির সেই অভিযোগ খারিজ হয়।
ড. মসিউর রহমানের পর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নামও আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত শিরীন ২০১৩ সালের এপ্রিলে জাতীয় সংসদের সবচেয়ে তরুণ স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি এখনো এ দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের পরর্বতী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অনেকদিন ধরেই আলোচনায় আছেন। বিশেষ করে আবদুল হামিদ দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর শিরীন শারমিনের নাম আলোচনায় আসে। এরপর তিনি দ্বিতীয়বার স্পিকার হন। তখন থেকেই এ আলোচনা আছে।
অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় আছেন দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আওয়ামী লীগের টানা ৩ বারের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নামও উঠে এসেছে আলোচনায়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, সামনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেকোনো সংকট তৈরি হলে সাহসিকতা, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে যিনি সংকট থেকে উত্তরণে অবস্থান নিতে পারবেন, তেমন কাউকেই এ পদে বসাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক কিছু বিবেচনা করেই রাষ্ট্রপতি পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। বিশ্বস্ত, দলের আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ ও অনুগত ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি পদে বিবেচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য