-->

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে তৎপর অসাধু চক্র

মো. রেজাউর রহিম
নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে তৎপর অসাধু চক্র

মো. রেজাউর রহিম: আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে একটি অসাধু চক্রের অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর ও মসলার চাহিদা তুলনামূলকভাবে কিছুটা বাড়তি থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের একটি চক্র ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে তৎপর রয়েছে। তবে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে অবৈধ মজুত রোধ এবং ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো রোধকল্পে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা করছে সরকার।

 

এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং বাজারে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর চাহিদা, আমদানি, মজুত ও সরবরাহ পরিস্থিতির পর্যালোচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি রমজানে পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

জানা গেছে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ পণ্যেরই দাম বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের একটি চক্র আগেভাগেই বাড়তি মুনাফার জন্য বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির শুরু করে। রমজান মাসে ব্যবসায়ীদের এমন অপতৎপরতায় সরকারও বেশ বিব্রত। এ কারণে রোজা সামনে রেখে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

 

ইতোমধ্যে বাজারে বাড়তে শুরু করেছে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, হলুদ, মরিচ, এলাচ ও দারুচিনির মূল্য।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর আমদানি, সরবরাহ, মজুত এবং চাহিদা পর্যালোচনার কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ বছর ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্রের) জটিলতাও রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে এবং দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

 

এর মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা, যা ডলার সংকটের এ সময়ে এলসির অনিশ্চয়তা অনেকটা কমাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে মজুতদারি, কালোবাজারি এবং এলসি খোলা নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও নির্দেশনা রয়েছে তার। তিনি বলেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

এদিকে বাজার বিশ্লেষকরাও বলছেন, পণ্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আমদানি ও ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন।

 

আমদানিকারকরা জানান, বিভিন্ন জটিলতার মধ্যেও যেসব এলসির পণ্য বন্দরে আসছে, ডলার সংকটের কারণে সঠিক সময়ে চালান খালাস করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি চাহিদা থাকলেও ব্যাংকিং জটিলতায় এলসি খুলতে পারছেন না মাঝারি সারির ব্যবসায়ীরা। ফলে করোনাকালীন সময়ের তুলনায় নিত্যপণ্য আমদানি অনেকটা কমেছে। ঋণপত্র বা এলসি খোলার ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরিশোধিত চিনির এলসির পরিমাণ কমেছে ২৮ ভাগ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও ছোলার এলসি কমেছে ৪৭ ভাগ এবং খেজুরের এলসি কমেছে ৩০ ভাগ পর্যন্ত।

 

তবে এ সময়ে যেসব এলসি অনুমোদন বা খোলা হয়েছে, তা সময়মতো খালাস করতে পারলে এবং আগামী ১৫ ফেব্রæয়ারির মধ্যে ঘাটতি এলসি সম্পন্ন সম্ভব হলে আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

 

সূত্র জানায়, রমজানে পণ্য সরবরাহের প্রস্তুতি ও বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে কাজ শুরু করার জন্য বলা হয়েছে। বাজারে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। এ ছাড়া বন্দরে আমদানি পণ্য খালাসে এবং আমদানি জটিলতা দূরীকরণেও কাজ করছে সরকার।

 

এদিকে, রমজানসহ সারাবছর বাজারে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত পণ্য না কেনার আহব্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি সচিবালয়ে পণ্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রমজানে দাম নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। ভোক্তাদের রমজানে একসঙ্গে পুরো মাসের পণ্য কেনার প্রয়োজন নেই, আর রোজা শুরু হওয়ার প্রথম সাত দিন পণ্য কেনার যে উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়, সেটা পরিহার করতে হবে।

 

অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের বিরুদ্ধে এবং বাজার তদারকির জন্য ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান শিগগির জোরদার করা হবে। এ ছাড়া চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমদানি এবং এলসি সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

 

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রমজান মাস এলেই গত কয়েক বছর পণ্যের দাম নিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সংকট সৃষ্টি করে। এ বছর ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখাচ্ছেন তারা এলসি করতে পারছেন না। তবে বিষয়টি সমাধানে সরকার আগেই উদ্যোগ নিয়েছে।

 

যা ইতিবাচক হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রমজানে বাজারে পণ্য সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন কোনো রকম কারসাজি করে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি না করতে পারে, সে বিষয়ে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে এ চক্র সফল হতে পারবে না। তিনি বলেন, দেশের অনেক ব্যবসায়ী সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।

 

তাদের অপতৎপরতা ঠেকাতে সরকারের আগাম প্রস্তুতিও থাকতে হবে, যাতে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র বাজার অস্থিতিশীলতার মাধ্যমে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি না করতে পারে, সেজন্য আনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সক্রিয় থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version