এম সাইফুল ইসলাম: ‘মন যদি আকাশ হতো তুমি হতে চাঁদ/ভালোবেসে যেতাম শুধু হাতে রেখে হাত। সুখ যদি হৃদয় হতো তুমি হতে হাসি/হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিয়ে বলতাম তোমায় ভালোবাসি’। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালোবাসা’ দিবস। প্রকৃত ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট সময় বা দিনক্ষণ না থাকলেও এখন ‘ভালোবাসা দিবসে’ যেন বিশেষ রূপে বিশ্বব্যাপী ধরা দেয় ভালোবাসা।
মনের যত বাসনা, অব্যক্ত কথা ডালপালা মেলে ছড়াবে আজ বসন্তের মধুর হাওয়ায়। প্রেম-ভালোবাসায় মাতোয়ারা হওয়ার দিন পহেলা ফাল্গুন। ফাগুনের মাতাল হাওয়ার সঙ্গে আজ ভেসে যাবে প্রেমপিয়াসী তরুণ-তরুণী। ভালোবাসার রঙে রঙিন হবে হৃদয়। তরুণ-তরুণী ছাড়াও সব বয়সের মানুষের ভালোবাসার বহুমাত্রিক রূপ প্রকাশের এমন দিনে ভালোবাসা যেমন মা-বাবার প্রতি সন্তানের, তেমনি মানুষের প্রতি মানুষের। ভ্যালেন্টাইন্স ডের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে।
এছাড়া ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বাংলাদেশে কীভাবে ‘ভালোবাসা দিবস’ হয়ে উঠল, তারও রয়েছে ইতিহাস। ইতিহাস নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও প্রাণের আবেশে ভালোবাসার এদিনে আবেগ আর অনুভ‚তির মিশ্রণে বেশিরভাগ মানুষ মেতে ওঠেন ভিন্ন আমেজে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন অনেকেই শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও ফুলের কদর কমেনি সামান্যতম।
ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীতে এবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে ও বসন্তবরণে এক সপ্তাহে ৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। এছাড়া সাভার, ভৈরবসহ থেকে ফুল সরবরাহ করা হয়েছে রাজধানীসহ বড় বড় শহরে।
ইতিহাস : ইতিহাসবিদদের মতে, দুটি প্রাচীন রোমান প্রথা থেকে এ উৎসবের সূত্রপাত। এক খ্রিস্টান পাদ্রি ও চিকিৎসক ফাদার সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে দিনটির নাম ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ করা হয়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড দেন।
মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন ‘ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন্স’। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ভালোবেসে দিনটি বিশেষভাবে পালন করার রীতি ক্রমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে ভিন্নমতানুযায়ী সেন্ট ভ্যালেন্টাইন একজনকে ভালো বেসেছিলেন। চিঠিটি লিখেছিলেন তার কাছেই। ভ্যালেন্টাইন্স সর্বজনীন হয়ে উঠে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। দিনটি সর্বজনীন হওয়ার পেছনে রয়েছে আরো একটি কারণ। ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত ‘জুনো’ উৎসব। রোমান পুরানের বিয়ে ও সন্তানের দেবি জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ।
এদিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তাদের নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্ট ধমার্বলম্বীতে পরিণত হয় তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেথে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন্ট ডে’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বাংলাদেশে ‘ভালোবাসা দিবস’ হলো যেভাবে : বাংলাদেশে সর্বপ্রথম তৎকালীন যায়যায়দিন পত্রিকার সাংবাদিক এবং সম্পাদক শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে ‘ভালোবাসা দিবস’ পালন করেন। তিনি লন্ডনে পড়ালেখা করার সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। যায়যায়দিন পত্রিকার মাধ্যমে তিনি দেশবাসীর নিকট ‘ভালোবাসা দিবস’র কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে তাকে ভালোবাসা দিবসের জনক বলা হয়। এদিনে বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষ প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধবী, স্ত্রী এবং স্বামী, মা এবং সন্তান, ছাত্র এবং শিক্ষক ফুল, চকলেট, কার্ড এবং অন্যান্য জিনিস আদান প্রদানের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন। এদিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পার্ক এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলো কানায় কানায় পূর্ণ থাকে।
দিনটিকে ঘিরে প্রতিবার ঢাকাসহ সারা দেশেই বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা কমর্সূচির আয়োজন করে। দেশের টেলিভিশনেও দিবসটি ঘিরে নানা অনুষ্ঠান হাতে রাখে। তবে বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বিধিনিষেধ চলমান থাকায় এবারো একটু ব্যতিক্রমভাবে দিনটি কাটাবেন অনেকেই। এবার বড় ধরনের কোনো কনসার্ট বা অনুষ্ঠানের সুযোগ নেই। তাই বিশেষ করে দর্শনীয় স্থানগুলোয় ঘোরাঘুরি করেই সময় কাটাবেন অনেকেই।
রোববার থেকেই রাজধানীর শাহবাগসহ বিভিন্ন স্থানে ফুলের দোকানে চলছে উচড়েপড়া ভিড়। করোনার কারণে হতাশা কাটিয়ে পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে বেচাবিক্রি ভালো হওয়ায় দোকানিরাও বেশ খুশি। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। তবে বিধিনিষেধ থাকা সত্তে¡ও টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা, বটতলা, হাকিম চত্বর, ভিসি চত্বর, ফুলার রোড, ক্যাম্পাস শ্যাডো, বিবিএ অনুষদের সবুজ চত্বর, কার্জন হল, মুহসীন হল মাঠ সবই যেন পরিণত হবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলনমেলায়।
বেলুন আর ফেস্টুন নয়, মানুষের পদচারণায় মুখরিত হবে প্রিয় প্রাঙ্গণ। আর কে কাকে আগে ভালোবাসার কথা জানাবে অথবা প্রিয় মানুষটিকে আবারো আজ বলবে ‘ভালোবাসি’, সে প্রতিযোগিতাই হয়তো চলবে।
ভালোবাসা দিবসে ফুল বিক্রি : ফুল ছাড়া যেন বাঙালির বিশেষ কোনো দিবস বা অনুষ্ঠানে পূর্ণতা আসে না। তাই ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষে বেড়েছে ফুল বিক্রি। গত দুদিন থেকেই রাজধানীর শাহবাগসহ বিভিন্ন স্থানে ফুলের দোকানে চলছে উপচেপড়া ভিড়।
যশোরে এক সপ্তাহে ৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি : যশোর থেকে আমাদের প্রতিনিধি এসএম ফরহাদ জানান, ভ্যালেন্টাইন্স ডে ও বসন্তবরণে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালি মোকামে ফুল বিক্রির ধুম পড়েছে। গতকাল সোমবার এক দিনে মোকামে প্রায় ৩ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ কোটি টাকার গোলাপ হাতবদল হয়েছে।
সকালে সরেজমিন গদখালী গিয়ে দেখা যায়, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে গদখালী বগুড়া, রাজশাহী, গোপালগঞ্জ, পাবনা, চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকার ও ফড়িয়াদের দরকষাকষিতে জমে উঠেছে বাজার। মোকামে প্রতিটি গোলাপ (ক্যাপ ছাড়া) ২৫ টাকা ও ক্যাপসহ গোলাপ বিক্রি ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
পাঁচ দিন আগেও গোলাপের পাইকারি দাম ছিল প্রায় অর্ধেক। জারবেরা প্রতিটা ১০ থেকে ১৫, রজনীগন্ধা ১২, গøাডিওলাস ১৪ থেকে ১৮, জিপসি প্রতিমুঠো ৫০ ও কামিনী পাতা প্রতি মুঠো ২০ টাকা দরে পাইকারি বেচাবিক্রি হয়েছে। এছাড়া গাঁদাফুল প্রতি হাজার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে গোলাপ ফুল। এক দিনেই প্রায় ১০ হাজার পিস গোলাপ ফুল হাতবদল হয়েছে এ মোকামে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে ঝিকরগাছার সৈয়দপুর এলাকার ফুলচাষি আব্দুর কাদের বলেন, এবার রেকর্ড ২৫ টাকা পর্যন্ত গোলাপ বিক্রি করেছি। আর চায়না গোলাপ ৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন দিবসে তরুণীরা চুলের খোপায় পরার জন্য জারবেরা ফুল পছন্দ করেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুন ঘিরে গত পাঁচ দিনে ঝিকরগাছার গদখালী ফুল বাজার ও পানিসারা এলাকা থেকে অন্তত ৩ কোটি টাকার গোলাপ ফুল সারা দেশে পাঠানো হয়েছে।
এর মধ্যে রোববারে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১০ লাখ পিস গোলাপ বিক্রি হয়েছে। দিবস দুটি ঘিরে এ অঞ্চলের চাষিরা গেল এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করেছেন।
সাভার থেকে কামরুল হাসান রুবেল জানান, তুরাগ তীরে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর, আক্রাইন, সাদুল্লাপুর, মৈস্তাপাড়া, বাগ্নীবাড়ী, সামাইর, কালিয়াকৈর, ভবানীপুর, রাজারবাগ, নয়াপাড়া, খাগান ও কমলাপুরসহ সাভার উপজেলাধীন বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে গোলাপ ফুলের। গোলাপ চাষিরা জানান, সাভারে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে শুধু গোলাপের চাষ করা হয়। পাশাপাশি অন্য ফুলও চাষ হচ্ছে।
সাভার উপজেলার কৃষি অফিসার নাজিয়াদ আহমেদ জানান, এবার সাভার উপজেলায় ২৮০ হেক্টর জমিতে গোলাপে চাষ হয়েছে। আমরা প্রায় ২০ কোটি টাকার গোলাপ ফুল বিক্রি লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছি এ বছরে। এ পেশার সঙ্গে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কৃষক জড়িত।
ভৈরব থেকে নাজির আহমেদ আল-আমিন জানান, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ হারে দেশে ফুল উৎপাদন বেড়েছে এ অঞ্চলে। ভৈরবের কমলপুর গাছতলাঘাট গিয়ে দেখা যায়, মাঠভর্তি বাগানে শোভা পাচ্ছে টিউলিপ, গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, জিপসিসহ নানা জাতের ফুল।
শাহরিন ফ্লাওয়ার গার্ডেনের পরিচালক ফাহিম মিয়া জানান, চলতি বছর আমাদের ব্যবসা ভালো। বিক্রি ও উৎপাদন ভালো হওয়ায় খরচ বাদ দিয়ে এর তিন ভাগের এক ভাগ মুনাফা থাকবে বলেও জানান এ ফুল ব্যবসায়ী।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য