-->
শিরোনাম

যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পবিত্র শবেমেরাজ পালিত

ওবায়েদ ইবনে গনি
যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পবিত্র শবেমেরাজ পালিত

ওবায়েদ ইবনে গনি: যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার রাতে পবিত্র শবেমেরাজ পালিত হয়েছে। পবিত্র এ রজনী উপলক্ষে মহান আল্লাহর রহমত কামনায় সারা দেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে ও নিজ গৃহে কোরআনখানি, জিকিরসহ নফল ইবাদতে মশগুল ছিলেন। গতকাল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ‘পবিত্র শবেমেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’ শীর্ষক আলোচনা সভা এবং বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

 

ইসলাম ধর্মে শবেমেরাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মেরাজ শব্দের অর্থ হলো- ঊর্ধ্বগমন। লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রজনী উপমহাদেশে শবেমেরাজ নামে আখ্যায়িত। প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে এই রজনীতে মহানবী হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) অলৌকিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেন এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেইসঙ্গে জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। মহানবী (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর, তাৎপর্যপূর্ণ ও অলৌকিক ঘটনা হলো মেরাজ। এ রাতে যেসব আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে, তা অন্য কোনো রাতে ঘটেনি। এজন্য এ রাত অতি মূল্যবান। কেননা মেরাজের মাধ্যমেই নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক অর্থাৎ ফরজ করা হয়। এ রাতেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নির্দিষ্ট করা হয়। মেরাজের এ সফরে নবীজিকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনটি উপহার দেয়া হয়- ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, ২. সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো এবং ৩. এ উম্মতের মধ্যে যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে মৃত্যুবরণ করবে, তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়ার ঘোষণা। (মুসলিম)। নবী মুহাম্মদ (সা.) সশরীরে, সজ্ঞানে, জাগ্রত অবস্থায় জিবরাইল (আ.) ও মিকাইল (আ.)-এর সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মেরাজের রাতে সফর করেন। তিনি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমানে গমন করেন এবং ধারাবাহিকভাবে সপ্তম আসমান ও সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। এ সফরে নবীজির সঙ্গে পূর্ববর্তী নবীদের সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি নামাজে সবার ইমামতি করেন। (মুসলিম)।

 

বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের আগের কথা। এক রাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) শুয়েছিলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন, চোখ দুটি বুজে এসেছে। তবে হৃদয়-মানস ছিল জাগ্রত। এরই মাঝে আগমন করেন হজরত জিবরাইল (আ.)। তিনি নবীজিকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন জমজমের কাছে। একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হলো। তা ছিল ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ; তাতে জমজমের পানি। জিবরাইল (আ.) নবীজির বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করলেন। বের করে আনলেন নবীজির হৃদয়। জমজমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে আবার প্রতিস্থাপন করে দিলেন জায়গামতো। ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেয়া হলো নবীজির কলব। এরপর আনা হলো নবীজিকে বহন করার জন্য সাওয়ারী। প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট। নাম বোরাক। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির, যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় গিয়ে। এভাবে নবীজি (সা.) মুহূর্তেই পৌঁছে গেলেন বায়তুল মোকাদ্দাসে। বোরাক বেঁধে রাখা হলো পাথরের ছিদ্রতে। যে পাথরে অপরাপর নবীরা নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। নবীজি সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় জিবরাইল (আ.) নবীজির সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন। একটি দুধের অপরটি শরাবের। নবীজি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি (দীনের) স্বভাবসিদ্ধ বিষয়টি নির্বাচন করেছেন। নবীজি মদের পেয়ালা নেয়ার পরিবর্তে দুধের পেয়ালা গ্রহণ করায় জিবরাইল (আ.) বলেন, আপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন, তাহলে আপনার উম্মত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। (বোখারি)।

 

এ ঘটনার পর শুরু হয় ঊর্ধ্বজগতের সফর। জিবরাইল নবীজিকে নিয়ে চললেন। প্রথম আসমানে গিয়ে দস্তক দিলেন। এরপর নবীজি উঠতে থাকলেন দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ আসমান। এভাবে নবীজি সপ্তম আসমানের দিকে উঠতে থাকেন। সপ্তম আসমানে দেখা হয় হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে। জিবরাইল আ. পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ ইনি আপনার পিতা, সালাম করুন। নবীজি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সালাম বিনিময় করলেন। নবীজি বলেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন বায়তুল মামুরে হেলান দিয়ে ছিলেন। বায়তুল মামুর, যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা আসে। এরপর এই ৭০ হাজার আর ফিরে আসে না। এভাবে প্রতিদিন ৭০ হাজার করে ফেরেশতাদের নতুন নতুন কাফেলা আসতে থাকে। এরপর নবীজিকে নিয়ে যাওয়া হলো সিদরাতুল মুনতাহার দিকে। সেখানে কুলবৃক্ষের একেকটি পাতা হাতির কানের মতো। আর একেকটি ফল মটকার মতো বড় বড়। জিবরাইল (আ.) বললেন, এটা সিদরাতুল মুনতাহা। এখানে চারটি নহর। দুটি অদৃশ্য আর দুটি দৃশ্যমান। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, দৃশ্যমান নদী দুটি কোনগুলো? জিবরাইল বললেন, অদৃশ্যমান দুটি জান্নাতে। আর দৃশ্যমান দুটি হলো নীল নদ ও ফুরাত নদী। এরপর আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নবীজির সাক্ষাৎ হলে তাঁর প্রতি যে ওহি পাঠালেন, তা হলো দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। আর প্রত্যেক নামাজের বিনিময়ে দশ ওয়াক্ত নামাজের সাওয়াব পাওয়া যাবে। এভাবে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়লে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের সাওয়াব পাবে।

 

এ সফরে নবীজি দেখলেন, একদল লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? জিবরাইল বললেন, এরা বক্তব্য করত বটে, কিন্তু নিজেরা আমল করত না। (মুসনাদে আহমাদ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) মেরাজ থেকে ফিরে হাতীমে বসা। মুশরিকরা ইসরা ও মেরাজের ঘটনা শুনে উপহাস ও কটাক্ষ করতে লাগল। বিভিন্নভাবে নবীজির দিকে প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগল। তারা চাইল- বায়তুল মোকাদ্দাসের পূর্ণ বিবরণ শুনবে। নবীজি এমন প্রশ্নে খুবই বিব্রত হয়ে ওঠেন। এত রাতে বায়তুল মোকাদ্দাসকে ওরকম নিখুঁতভাবে দেখতে পেয়েছেন নাকি! নবীজি বলেন, এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমি আগে পড়িনি। আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বন্ধুকে সাহায্য করলেন। নবীজির চোখের সামনে মেলে ধরলেন বায়তুল মোকাদ্দাসের দৃশ্য। নবীজি দেখে দেখে তাদের প্রত্যেকটি জিজ্ঞাসার বিস্তারিত জবাব দিলেন। (বোখারি ও মুসলিম)। মক্কার কোনো এক পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন হজরত আবু বকর (রা.)। মক্কার কাফেররা তাকে এ বিস্ময়ের কথা বলে জিজ্ঞাসা করল- তবু কি তুমি তাকে বিশ্বাস করবে? এ সময় হজরত আবু বকর সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়ে আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানী বার্তাগুলোর ওপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান। (তিরমিযী)।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version