-->

রেশমার চোখে ’৫২-এর ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন

কামরুল হাসান রুবেল, সাভার (ঢাকা)
রেশমার চোখে ’৫২-এর ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন
শিশুসন্তান কোলে রেশমা

কামরুল হাসান রুবেল, সাভার (ঢাকা): কোটি মানুষের প্রাণের ভাষা বাংলা, সে ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলেই সর্বপ্রথম যার মুখটি বাঙালির সামনে ভেসে ওঠে, তিনি হলেন ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন। ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তিনি ভাষা মতিন নামেই বাঙালির কাছে পরিচিত। ভাষা আন্দোলনে তার অবদান চিরস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক সংগ্রামী নেতা।

 

১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহব্বায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তটি পাস হয়েছিল তার জ্বালাময়ী ভাষণের প্রভাবে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য রাজপথে নেমেছিলেন শত শত বাঙালি। আব্দুল মতিন ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকগমন করেন।

 

ভাষা মতিন আমাদের মাঝে নেই, তবে এখনো তার চোখের জ্যোতি পৃথিবীতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার চোখের আলো ধারণ করছেন রেশমা নামে একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ভাষা মতিনের দান করা চোখের কর্নিয়ার মাধ্যমে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন তিনি। একজন ভাষাসংগ্রামীর কর্নিয়ায় নিজের চোখের আলো ফিরে পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করেন রেশমা। রেশমা বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

 

ধামরাইয়ের সূয়াপুর ইউনিয়নের শিয়ালকুল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল বারেক ও মোসা. মুসলিমা বেগমের তৃতীয় সন্তান রেশমা। তিনি জানান, মাত্র ৭ বছর বয়সে তার বাম চোখে সমস্যা দেখা দেয়। সে সময় তার চোখ অনেক চুলকাত। এরপর ধীরে ধীরে চোখের সমস্যা বাড়তে থাকে। একের পর এক ডাক্তার দেখিয়েও কোনো সমাধান পাননি। এরপর চোখ চুলকানোর সঙ্গে সঙ্গে পানি পড়া শুরু হয়। কমতে শুরু করে চোখের দৃষ্টি শক্তি।

 

চোখের সমস্যা নিয়েই ২০১৩ সালে ধামরাই সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন রেশমা। তখন তার বাম চোখের দৃষ্টি নিবুনিবু অবস্থা। এ সময় এক প্রতিবেশীর পরামর্শে বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতি পরিচালিত ওএসবি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান। সেখান থেকে প্রথম তার কর্নিয়ার সমস্যার কথা জানতে পারেন।

 

সেখানকার চিকিৎসক রেশমাকে জানান, বাম চোখের কর্নিয়ার কারণে ডান চোখেও সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশে কর্নিয়া সহজে পাওয়া যায় না বলে ইন্ডিয়ায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। এতে পরিবারের সদস্যরা আরো দুশ্চিন্তায় পড়েন। কিছুদিন পার হতেই ২০১৩ সালে তার বাম চোখের আলো পুরোপুরি নিভে যায়। অন্ধ হয়ে যান রেশমা। এরপর ২০১৩ সালে চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি সন্ধানীতে কর্নিয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন। কিন্তু তার চোখের কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছিল না।

 

রেশমা বলেন, সন্ধানীতে কর্নিয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করার এক মাসের মাথায় আমরা ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট তৈরি করতে দিলাম। ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর টেলিভিশনে সংবাদ দেখতে পাই যে, ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন মারা গেছেন এবং তার দুটি কর্নিয়া দান করে গেছেন। তখন সঙ্গে সঙ্গে সন্ধানীতে যোগাযোগ করি। রেশমা জানান, সন্ধানীতে যোগাযোগ করলে ৯ অক্টোবর সকালে তাকে হাসপাতালে ডাকা হয়।

 

পরে তার চোখের কর্নিয়ার সঙ্গে ভাষাসংগ্রামী মতিনের কর্নিয়ার হস্তান্তর সম্ভব হবে বলে নিশ্চিত করেন চিকিৎসক। এরপর সেদিন বিকেলেই রেশমার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয় সন্ধানী হাসপাতালে। ১০ অক্টোবর সকালে রেশমা আবার ফিরে পান তার চোখের আলো।

 

এমন একজন গুণী মানুষের কর্নিয়া পেয়ে রেশমা গর্বিত এবং নিজের জীবনকে সার্থক বলে জানান তিনি। রেশমা বলেন, তার মতো বড় মাপের মানুষ তো হতে পারব না, কিন্তু তার দেয়া কর্নিয়া দিয়ে মানুষের সেবা করে যেতে চাই। প্রতি বছর ৮ অক্টোবর ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিনের মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন রেশমা। গ্রামের সাধারণ মানুষের সেবা করার পাশাপাশি মরণোত্তর দেহদান নিয়ে সাধারণ মানুষের যে ভীতি রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

 

শুধু চোখের আলো নয়, ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিনের আদর্শও ধারণ করতে চান রেশমা। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মরণোত্তর চক্ষুদান করবেন। রেশমা বলেন, আগে ভাবতাম চোখ দান করা ভালো নয়, এখন তার (ভাষা মতিন) চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখে আমিও অনুপ্রাণিত হচ্ছি। একজনের দান করা চোখে আরেকজন যদি দুনিয়ার আলো দেখতে পারে, তার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।

 

আমার ডান চোখটা যদি ভালো থাকে, ইনশাল্লাহ আমি দান করে যাব।

 

ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের মা রেশমা মাঝে মাঝেই সন্তানদের শোনান দেশের জন্য আত্মত্যাগ করা মহান ব্যক্তিত্বদের জীবনের গল্প। বিশেষ করে ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিনের মহান ত্যাগের কথা, ভাষা আন্দোলনে তার বীরত্বগাথা ও অবদানের গল্প শোনান।

 

রেশমা বলেন, আমার সন্তানরা যেন মানুষের উপকারে আসতে পারে, সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। ওরা যদিও ছোট তারপরও ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিনসহ অন্য ভাষাসংগ্রামীদের কথা জানে। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, তিনিও সবসময় ইতিহাস জানান। দেশের জন্য, ভাষার জন্য তাদের জীবন বিলিয়ে দেয়ার গল্প শোনান।

 

রেশমা আরো বলেন, তাার মতো বড় মাপের মানুষ তো হতে পারব না, কিন্তু তার দেওয়া কর্নিয়া দিয়ে মানুষের সেবা করে যেতে চাই।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version