-->
শিরোনাম

মাথা নত না করার দিন

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
মাথা নত না করার দিন

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: সৃষ্টির আদি থেকে স্বাধীনতার জন্য মানুষ নানা ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মুক্ত বাতাস কিনতে প্রাণ ঢেলে দিতে দুবার ভাবেননি। নিজের জীবন দিয়ে অন্যদের দিয়ে গেছেন অমলিন স্বাধীনতা। কবির ভাষায়Ñ স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে/কে পরিবে পায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই স্বাধীনতার সুখে বিভোর হতে চান।

 

কারণ সোনার খাঁচায় বন্দি হয়ে নিত্যদিন আপেল খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে উড়ে না খেয়ে মরা শ্রেয়। এই স্বাধীনতা ছিল না বাংলার মানুষের। পদে পদে স্বাধীনতা হরণ হতে হতে একসময় নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু হারাতে বসেন তারা। মুখের ভাষা কাইড়া নেয়ার পাঁয়তারা করে পাকিস্তানি শাসকরা। তাদের পরিকল্পনা বানচাল করে জীবনের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখেন সালাম-বরকতরা। যুগের লিপি মুছে গেলেও বাঙালি জাতি তাদের ভুলবে না।

 

বাঙালির জীবনে অনন্য চিরঅমলিন, চিরভাস্বর, চিরস্মরণীয় একুশে ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসের পাতায় পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচ‚ড়া হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরের রক্তে রাঙানো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস আজ। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ এই দিনটি একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

 

দিনটি এলেই আমরা ভাষা শহীদদের উদ্দেশে গেয়ে উঠি মাগো আটই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই, গেয়ে উঠি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি কিংবা বাংলা আমার প্রাণের ভাষা বাংলা আমার প্রাণ/ মা ডাকি তাই বাংলাতে আজ বাংলাতে গাই গান।

 

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটেছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দেয়ার ঘটনা। ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা’ স্লোগানে মাতৃৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাঙালি তরুণ প্রজন্ম। একুশের চেতনা আমাদের আত্মমর্যাদাশীল করেছে। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ চিরকালের এ স্লোগান তাই আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশের স্কুল-কলেজ, জেলা ও থানা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। পাড়ায়-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের নিজ হাতে গড়া শহীদ মিনারও আজ সেজে উঠবে নতুন প্রজন্মের ফুলেল শ্রদ্ধায়।

 

১৯৫২ সালের এ দিনে ভাষা শহীদদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চ‚ড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চিরপ্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

 

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে যাচ্ছি।’

 

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রদেশের ভাষা কী হবে, তা প্রদেশবাসীই স্থির করবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউররা শাহাদাতবরণ করেন।

 

অমর একুশের অনুষ্ঠান আজ আর কেবল বাঙালির নয়, নয় শুধু বাংলাদেশের। দেশের সীমানা পেরিয়ে ভাষা দিবস হয়ে উঠেছে বিশ্বমানের। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূত্রপাত বাংলাদেশে হলেও ইউনেস্কোর অনুমোদনে এখন বিশ্বজুড়েই উদযাপিত হয়ে আসছে অমর একুশের অনুষ্ঠান। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশ, সব জাতি ২১ ফেব্রুয়ারি নিজ নিজ মাতৃভাষার কথা স্মরণ করে। উদযাপন করে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতীক।

 

রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।

 

এছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, প্রত্ন তত্ত অধিদপ্তর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট,

 

খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমি, বিরিশিরি, নেত্রকোনা, রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, মনিপুরী ললিতকলা একাডেমি, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রন্থমেলা, আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, সুন্দর হাতের লেখা ও রচনা প্রতিযোগিতাসহ অন্যান্য বছরের মতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version