এম বদি-উজ-জামান: বহুল আলোচিত পিলখানায় সংঘটিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের ১৪ বছর অতিবাহিত হলেও ওই ঘটনায় হওয়া পৃথক দুটি মামলার একটিতেও বিচার চুড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়নি। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ওই ঘটনায় করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় হাইকোর্টে বিচার সম্পন্ন হলেও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে করা মামলায় নিম্ন আদালতে কবে নাগাদ বিচার সম্পন্ন হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এ অবস্থায় হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের করা পৃথক আপিল আবেদন এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ আপিলের ওপর চলতি বছরই আপিল বিভাগে শুনানি হতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ থাকলেও আসামিপক্ষের কারণে শুনানিতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর কয়েকজন আসামির সাজা বাড়াতে ও কয়েকজন আসামিকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে করা আপিলের সারসংক্ষেপ এরই মধ্যে আপিল বিভাগে দাখিল করা হয়েছে। তবে আসামিপক্ষ থেকে করা আপিলের সারসংক্ষেপ এখনো দাখিল করা হয়নি। এটা দাখিল করতে তাদের আরো এক মাস সময় লাগতে পারে বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম।
আসামিপক্ষ সারসংক্ষেপ দাখিল করলেই প্রধান বিচারপতি শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। নিয়মানুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে উভয়পক্ষ আপিল আবেদন দাখিল করার পর আপিলের সারংক্ষেপ দাখিল করতে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে উভয়পক্ষকে নোটিশ দেয়া হয়। এ নোটিশ পাওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিল করেছে। কিন্তু আসামিপক্ষ এখনো সারসংক্ষেপ দাখিল করেনি।
জানা গেছে, সাজাপ্রাপ্ত সব আসামির পক্ষে পৃথকভাবে সারসংক্ষেপ দাখিল করতে হচ্ছে বিধায় তা দাখিলে সময় লাগছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আসামিপক্ষের সব সারসংক্ষেপ দাখিল করা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। এ সারসংক্ষেপ দাখিল হলেই প্রধান বিচারপতি আপিল আবেদনের শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন এবং শুনানির দিন ধার্য করবেন।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত হলে আদালতে শুনানি শুরু কতরার আরজি জানাব। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর আপিল শুনানি হতে পারে।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষে করা আপিল ও লিভ টু আপিল একসঙ্গে শুনানি হবে।’
জানা যায়, হাইকোর্টের রায়ের পর সাজা বাড়াতে ও খালাস পাওয়া কয়েকজন আসামিকে সাজার আওতায় আনতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৩৩টি আপিল ও লিভ টু আপিল আবেদন দাখিল করা হয়েছে। এর সারসংক্ষেপ ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট শাখায় জমাও দেয়া হয়েছে। আর আসামিপক্ষ থেকেও একাধিক আপিল ও লিভ টু আপিল আবেদন দাখিল করা হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামিরা আপিল করলেও যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা এবং রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
তবে ওই প্রশ্নের নিষ্পত্তির পর প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এ সারসংক্ষেপ দাখিল করতে যাচ্ছে আসামিপক্ষ। এখন প্রত্যেক আসামিরপক্ষে পৃথক পৃথক সারসংক্ষেপ দাখিল করার প্রস্তুতি নিয়েছে আসামিপক্ষ।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যার ঘটনায় ওই বছরের ৪ মার্চ লালবাগ থানার ওসি নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পরে মামলাটি ৭ এপ্রিল নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। ডিএডি তৌহিদসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে করা মামলায় অজ্ঞাত আসামি দেখানো হয় প্রায় ১ হাজার জওয়ানকে। তদন্ত শেষে সিআইডি ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দুটি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়।
এর মধ্যে হত্যা মামলায় বিচার শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলায় রায় দেয়। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। আর ২৭৮ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। এরপর ফাঁসির আসামিদের সাজা অনুমোদনের জন্য নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। কারাবন্দি আসামিরা সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও পৃথক তিনটি আপিল করা হয়।
উভয় আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর প্রকাশ্য আদালতে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। এছাড়া নিম্ন আদালতের সাজা বিরুদ্ধে ২৮ জন আপিল না করায় তাদের সাজা বহাল রাখা হয়। সব মিলিয়ে ৫৫২ জনকে সাজা দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে ২৮৩ জনকে খালাস দেয়া হয়।
নিয়মানুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা এ আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এ নৃশংসতম হত্যাকান্ডের কারণে সরকার বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামকরণ করেছে।
এদিকে একই ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে অভিন্ন আসামিদের বিরুদ্ধে করা মামলায় নিম্ন আদালতে এখনো বিচার সম্পন্ন হয়নি। এ মামলায় ২০১০ সালে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলেও গত ১২ বছরে ১ হাজার ২৬৪ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৫৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। ফলে এ মামলায় নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হয়ে রায় প্রদানে আরো কয়েক বছর লেগে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
কর্মসূচি: পিলখানা দিবসটি পালন করতে বিজিবি ও সেনাবাহিনী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী শহীদ ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনায় পিলখানার বিজিবি সদর দপ্তর এবং বিজিবির সব মসজিদ ও সব সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় পবিত্র কোরআন খতম, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
দিবসটি পালনে বিজিবির সব স্থাপনায় বিজিবি রেজিমেন্টাল পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবির সব সদস্য কালোব্যাজ পরিধান করবেন। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ শনিবার সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানরা (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) ও শহীদদের নিকটাত্মীয়রা স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য