রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার বিকেলে আরো দুই লাশ উদ্ধার হলে নিহতের সংখ্যা ২০-এ দাঁড়ায়। এছাড়াও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক। আহতদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইউনিট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ঘটনার পর পরই ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনীর দল উদ্ধার তৎপরতায় কাজ করে যাচ্ছেন। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানেও কাজ করা হচ্ছে, পাশাপাশি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় পুরো এলাকা কেঁপে উঠে। মুহূর্তেই সাধারণ মানুষ বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় ছোটাছুটি করতে থাকে। রাস্তায় চলাচল করা যানবাহনও কেঁপে ওঠে এ বিস্ফোরণে। ভবনে থাকা লোকজনসহ রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি ও আশপাশের ভবনের গ্লাস ভেঙে পড়েও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যায়, যে যেভাবে পেরেছে হাসপাতালের দিকে ছুটেছে। অ্যাম্বুলেন্স, ঠেলাগাড়ি, রিকশা অপর্যাপ্ত ছিল। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ছুটে এসেছেন আহতদের সাহায্যার্থে। মঙ্গলবার বিকেলের বিস্ফোরণের পর গতকাল বুধবারও পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা চালান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রাস্তায় চলাচলের মাঝে এমন বিস্ফোরণের শব্দে মনে হচ্ছিল পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। এটি কেমন ভয়াবহতা ছিল, তা আসলে বোঝানো যাবে না। দিগি¦দিক মানুষ ছোটাছুটি করছিল। আহতদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হতাহতদের স্বজন ও উৎসুক জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশকে মৃদু লাঠিচার্জও করতে হয়।
এদিকে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন, ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে মোট ১৮ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে।
তারা হলেন- কুমিল্লার মেঘনা থানার বাসিন্দা কাতার প্রবাসী মো. সুমন (২১), তিনি রাজধানীর ১ নম্বর সুরিটোলা বংশাল এলাকায় পরিবারসহ থাকতেন। বরিশাল জেলার কাজির হাট থানার চর সন্তোষপুর গ্রামের ইসহাক মৃধা (৩৫), তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ঢাকেশ্বরী ২ নম্বর রে ডে বসবাস করতেন ও ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। পশ্চিমপাড়া যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মুনসুর হোসেন (৪০), ৯৭ লুৎফর রহমান লেন, আলু বাজারের বাসিন্দা মো. ইসমাইল (৪২), চাঁদপুর জেলার মতলব থানার পশ্চিম লালপুর গ্রামের বাসিন্দা আল আমিন (২৩), তিনি বিবিএ ছাত্র ছিলেন, কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ চৈনকুটিয়া গ্রামের রাহাত (১৮), ১১৫/৭/৫ ইসলামবাগ, চক বাজার থানার মমিনুল ইসলাম, একই এলাকার নদী বেগম (৩৬), জেলা মুন্সীগঞ্জ সদরের সৈয়দপুর গ্রামের মাঈন উদ্দিন (৫০), ৪৭ নং কে পি ঘোষ স্ট্রিট, বংশাল এলাকার নাজমুল হোসেন (২৫), তিনি আজাদ স্যানিটারি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। মানিকগঞ্জ সদরের চর বেউথা গ্রামের বাসিন্দা ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার বালুয়াকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আবু জাফর, ১৮/১ আগামাসি লেন, বংশাল এলাকার আকুতি বেগম (৭০), মীর হাজারীবাগ যাত্রাবাড়ী এলাকার মো. ইদ্রিস মির (৬০), যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া (৫৫) ও বংশাল থানার সিদ্দিকবাজার জাবেদ গলি এলাকার হৃদয় (২০), মো. সম্রাট (২২) ও মোহাম্মদ সিয়াম (২০)।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, এ পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছেন। আর আহত শতাধিক। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। জানা গেছে, বিস্ফোরণের পর উদ্ধার কাজে অংশ নেয় ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট। মোট পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সে হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
নিখোঁজদের জন্য অপেক্ষা স্বজনদের : বিস্ফোরণে ধসে পড়া ভবনের আশপাশে অপেক্ষা করছেন স্বজনরা। গতকাল বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সকাল থেকে নিখোঁজ স্বজনের জন্য ভবনটির পাশে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো. আরিফ। তিনি বলেন, আমার বন্ধু মোমিন উদ্দিন সুমন এই ভবনের নিচতলায় একটি অফিসে কাজ করত। গতকাল এই ভবনে বিস্ফোরণ হওয়ার খবর শুনেই ওকে কল করতে থাকি। মোবাইলে কল ঢুকেছে কিন্তু রিসিভ করেনি।
গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত মোবাইলে কল বেজেছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ৯টার পর আর কল ঢোকেনি। উদ্ধারকারীরা ওর মোবাইলটা পেয়েছে, কিন্তু আমার বন্ধুকে এখনো পাওয়া যায়নি।
দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন আবদুল মান্নান। তার মেয়ের স্বামী মেহেদি হাসান (স্বপন) এখানে একটি দোকানে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু বাদে সেখানে এলেন স্বপনের ভাই সোহাগ। তাকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন মান্নান। সোহাগ কাল থেকে হাসপাতালে হন্যে হয়ে ভাইকে খুঁজেছেন। কিন্তু পাননি। সোহাগ বলছিলেন, ‘উদ্ধারকাজ দ্রুত শুরু হওয়া দরকার। আমরা ভাইরে খুঁজে পেতে চাই।’
বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ১০ জনের কেউ শঙ্কামুক্ত নন : শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় চিকিৎসাধীন ১০ জনের কেউই শঙ্কামুক্ত নন। গতকাল বুধবার বার্ন ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গতকালের দুর্ঘটনায় আমাদের এখানে ১১ জন রোগী ছিল, তার মধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিকেলে ট্রান্সফার করা হয়েছে, তার বার্ন নেই। যে ১০ জন আছে তার মধ্যে তিনজন আইসিইউতে, দুজন লাইফ সাপোর্টে। বাকিরা আছেন এইচডিইউতে। চিকিৎসাধীন ১০ জনের কেউই শঙ্কামুক্ত নয় জানিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক বলেন, যারা আছেন তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নন। কারো শরীরের ৮০ শতাংশ, কারো ৯০ শতাংশ, কারো ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আমরা কাউকে শঙ্কামুক্ত বলতে পারব না।
তদন্ত কমিটি গঠন : বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুর্ঘটনার পরদিন এ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে এ তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেবে। ফায়ার সার্ভিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। ওই কমিটির বাকি তিন সদস্যের নাম পরে জানানো হবে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তদন্ত কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবস সময় দেয়া হয়েছে তদন্তকাজ পরিচালনার জন্য।
নিহত-আহতদের নগদ সহায়তা দেবে জেলা প্রশাসন : বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার করে টাকা সহায়তা দেবে ঢাকা জেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার করে টাকা দেয়া হবে। সামান্য আহত ব্যক্তিরা পাবেন ১৫ হাজার করে টাকা। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের নগদ ৫০ হাজার টাকা; যারা গুরুতর আহত হয়েছেন, তাদের নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং যারা সামান্য আহত হয়েছেন, তাদের ১৫ হাজার টাকা করে প্রদান করছি।’
দুর্ঘটনায় সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে জেলা প্রশাসন একটি সহায়তা বুথ স্থাপন করেছে বলে জানান মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, এই বুথে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকরা রয়েছেন। বুথ থেকে যারা আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা, যানবাহন সহায়তাসহ সব ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য