-->
শিরোনাম

হাতে থাকা ইভিএম ব্যবহার নিয়েও সংশয়ে ইসি

শাহীন রহমান
হাতে থাকা ইভিএম ব্যবহার নিয়েও সংশয়ে ইসি

শাহীন রহমান: প্রথমে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একনেকে প্রকল্প পাস না হওয়ায় সেখান থেকে আগেই পিছু হটতে হয়েছে। এবার হাতে থাকা ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ ইসির হাতে যেসব মেশিন রয়েছে, তার অধিকাংশই নষ্ট।

 

মেরামত ছাড়া এটি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। মেরামতে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে টাকা চেয়ে চিঠি দিলেও সেখান থেকে কাক্সিক্ষত সাড়া আসেনি। ফলে নতুন করে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সাড়া না দিলে আগামী নির্বাচন ব্যালটেই করতে হবে।

 

নির্বাচন কমিশন থেকে বরাবরই বলে আসছে, হাতে থাকা মেশিন দিয়ে ৭০ থেকে ৮০ আসনে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হবে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসির হাতে দেড় লাখের মতো ইভিএম মেশিন রয়েছে। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে কেনা এসব মেশিন বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত জাতীয় নির্বাচনে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৬টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়।

 

এছাড়াও বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনায় এসব মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে। ইসি সূত্রে জানা গেছে, দেড় লাখ মেশিনের বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ইভিএম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) ও ইসির পরীক্ষায় দেখা যায়, এসব ইভিএম ভাঙা ও ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে।

 

ইভিএমের ভেতর পানি ও কাদামাটি জমা আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিকিউরড কানেক্টিং কেবল নেই। ফলে সচল থাকা ইভিএমগুলো দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে শুধু ১৫-২০টি আসনেই ভোটগ্রহণ সম্ভব হবে।

 

সোমবার বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার নিয়ে অন্ধকারে নির্বাচন কমিশন। ইভিএম নিয়ে কি হবে না হবে জানি না। কারণ হাতে থাকা মেশিনগুলো ব্যবহারযোগ্য করতেই প্রয়োজন এক হাজার ২৬০ কোটি টাকা। গত ১৫ মার্চের কমিশন বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।

 

এক হাজার ২৬০ কোটি টাকার মতো লাগবে এক লাখ ১০ হাজার ইভিএম মেরামত করার জন্য। সেটা পাওয়া যাবে কিনা, নিশ্চিত করার জন্য আমরা একটা চিঠি দিতে বলেছি। তা রেডি হয়েছে। মঙ্গলবার সেই চিঠি পাঠানো হবে।

 

দেড়শ আসনে ভোটের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকার ইভিএম মেশিন ক্রয় প্রকল্প আগেই স্থগিত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। প্রকল্প স্থগিত হওয়ার পর হাতে থাকা মেশিন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। হাতে থাকা ইভিএম দিয়ে কত আসনে ভোট করা সম্ভব হবে, তা যাচাই করতে সম্প্রতি কমিশন সভা ডাকা হয়।

 

সভায় জানানো হয়, ইসির সংগ্রহে থাকা ইভিএমগুলো সচল করতে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার নতুন যে প্রস্তাবনা ছিল, অর্থ মন্ত্রণালয় তাতে সায় দেয়নি। ফলে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হয়। একই সঙ্গে ইভিএম মেরামতের টাকা চেয়ে আবারো অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সাড়া দেবে কিনা তা জানতেও চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

 

ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, কত আসনে ইভিএমে ভোট হবে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষেই চূড়ান্ত করা হবে।

 

ইসি আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ইভিএমে মেরামতের জন্য টাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে। যদি অর্থ বিভাগ টাকা সংস্থান করে, তাহলে ইভিএমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর যদি টাকা না পাওয়া যায়, তাহলে ব্যালটে কতটা করা হবে বা ইভিএমে আদৌ করব কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সবটাই নির্ভর করবে অর্থপ্রাপ্তির ওপর।

 

ইভিএম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) নষ্ট ইভিএম মেরামতের জন্য ছয় মাস সময়ের কথা জানিয়েছে। নির্বাচনের আগে এটা চূড়ান্ত সময় মনে করছে ইসি। এখন অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে মেরামতের কাজ শুরু করতে হবে। এ বছর ডিসেম্বরের শেষ অথবা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি।

 

তার আগে নভেম্বরের মাঝামাঝি তফসিল ঘোষণা করতে হবে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, ইভিএমে ভোট করতে হলে তফসিল ঘোষণার আগেই অকেজো ইভিএম মেরামত করতে হবে। ইভিএম মেরামতে ইসির হাতে এখন সময় রয়েছে আরো ৬ মাসের মাসের বেশি। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত ইসির প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। জানা গেছে, দ্রুত ইসির প্রস্তাবে সাড়া না দিলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ব্যালটেই প্রস্তুতি নিতে হবে ইসির।

 

ইসি আনিছুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, মধ্য এপ্রিল নাগাদ সাড়া পেলে ইভিএম মেরামতে ছয় মাস সময় পাওয়া যাবে। অন্যথায় কিন্তু সময় পাব না। ছয় মাস সময়ের পরে টাকা দিলে লাভ হবে না। কারণ এক লাখ ১০ হাজার মেশিন যদি ব্যবহারযোগ্য করতে পারি, তাহলে ৭০-৮০ আসনে ভোট করা সম্ভব হবে। না হলে সম্ভব হবে না।

 

সাংবাদিকদের তিনি জানান, হাতে থাকা ইভিএমের মধ্যে এক লাখ ১০ হাজার মেরামতযোগ্য। ৪০ হাজার মেরামত করলেও ব্যবহারযোগ্য হবে না। কাজেই আমরা এক লাখ ১০ হাজারই মেরামত করব। যদি আংশিক পাওয়া যায় বা কী হবে সে সিদ্ধান্ত হয়, সেটার ওপর নির্ভর করবে কত আসন।

 

এ বিষয়ে ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ‘অকেজো ও নষ্ট ইভিএম মেরামতের প্রস্তাব আমরা নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছি। এখন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি দেখভাল করছে।

 

জানা গেছে ইসির হাতে থাকা পুরোনো ইভিএমগুলো সচল রাখতে এবং নতুন করে ইভিএম মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি চালাচালির পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। বৈঠকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে আবারো চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। ইসির সংগ্রহে থাকা ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএমের মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজারই মেরামত করা লাগবে।

 

এর মধ্যে ৮০ হাজার ইভিএম ভারী এবং ৩০ হাজার ইভিএম হালকা মেরামতের প্রস্তাব দিয়েছে বিএমটিএফ। আর বাকি ৪০ হাজার ইভিএম পুরোপুরি অকেজা হয়ে গেছে। ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা করে কেনা এসব ইভিএমের একেকটি মেরামতেই ব্যয় হবে প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। সংকট সমাধান এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে ঠিক কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সংস্থাটি।

 

২০১০ সালের ১৭ জুন যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রচলন শুরু করে ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। সে সময় তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা করে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইভিএম তৈরি করে নেয়। ওই কমিশন এই যন্ত্রে ভোট নিয়ে সফলও হয়। পরবর্তীকালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভোট নিতে গেলে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ে।

 

সে মেশিনটি পরে আর ঠিক করতে পারেনি কমিশন। ফলে ওই মেশিনগুলো নষ্ট করে নতুন করে আরো উন্নত প্রযুক্তির ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় রকিব কমিশন। এর পর ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় বিএমটিএফ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম ক্রয় করে।

 

এসব মেশিন দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু নতুন মেশিন কেনার অর্থ ছাড়া না হওয়ায় এবং হাতে থাকা ইভিএম মেরামতে টাকা না পাওয়ায় ইভিএমে ভোটগ্রহণ নিয়ে এখনো অন্ধকারে রয়েছে নির্বাচন কমিশন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version