-->
বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আজ

অটিজম আন্দোলনে প্রশংসিত বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন
অটিজম আন্দোলনে প্রশংসিত বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন: অটিজম আন্দোলনে বিশ্বে সাড়া ফেলেছে বাংলাদেশ। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অটিজম আন্দোলনের প্রভাবে অনেক অটিস্টিক শিশু মূলধারায় ফিরে আসছে। অসহায় পিতামাতা হতাশা কাটিয়ে পাচ্ছে উৎসাহ, সাহস আর আশ্রয়।

 

বিশ্বে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে অটিস্টিক শিশুদের মধ্য থেকে তৈরি হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

 

সমাজসেবা অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশের ভূমিকায় বিশ্বে জাগরণ তুলেছে অটিজম আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ঐকান্তিক চেষ্টায় অটিজমের গুরুত্ব ও সচেতনতা জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুদিন আগে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ অটিজম-সংক্রান্ত কার্যক্রম এগিয়েছে অভাবনীয়ভাবে।

 

১৪টি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স। ৮টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি। এর মধ্যে প্রথম সারির ৫টি হলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

 

সমাজসেবা অধিদপ্তর আরো জানায়, অটিজম বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ডাক্তার ও নার্স প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং উপজেলা পর্যায়ে প্যারামেডিক্স ও অভিভাবকদের অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আর দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে অটিজম ও অন্যান্য নিউরোডেভেলপমেন্ট সমস্যাজনিত শিশুদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে।

 

অটিস্টিক শিশু শনাক্তকরণের জন্য বাড়ি বাড়ি স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। পাইলটিং কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার আলোকে চলতি সেক্টর কর্মসূচিতে সারা দেশকে এই কার্যক্রমের আওতায় আনার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

 

অটিজম বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত করে তোলার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তিনি একজন মনোবিশেষজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজমসহ নিউরো-ডেভেলপমেন্টবিষয়ক কার্যক্রমকে সংগঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

মূলত তারই উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পেশ করে। এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর গৃহীত হয়।

 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, অটিস্টিক এবং প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে সে লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার। অটিস্টিকদের প্রতি দায়িত্ব যেমন তাদের অভিভাবকদের রয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রেরও রয়েছে। অটিস্টিকদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদানের জন্য প্রতিটি উপজেলায় ‘প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র’ চালু করা হবে। অটিস্টিকসহ সমাজের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এ মর্যাদা ভোগের সমান অধিকার রাখেন।

 

অটিজম কোনো ব্যাধি নয়, এটা জন্মগত একটি অসুবিধা। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার বা ‘প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র’ চালু রয়েছে। এসব কেন্দ্রের সঙ্গে একটি করে অটিজম কর্নারও চালু করা হয়েছে। এ কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত স¤প্রসারিত করা হবে।

 

প্রতিবন্ধিতা মানব বৈচিত্র্যের একটি অংশ। তাদের প্রতি অবজ্ঞা করার সময় শেষ হয়েছে। তাদের অধিকার এবং মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রতিটি মানুষেরই জন্মগতভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

 

সূত্রটি আরো জানায়, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, ২০১৩ নামে দুটি আইন পাস হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন হয়। এ ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ ফাউন্ডেশনকে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তরে’ রূপান্তর করা হয়েছে।

 

এই কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে একটি করে প্রতিবন্ধী কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল, অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন থেকে ইশারা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

 

এছাড়া অটিস্টিক শিশুর মায়েদের জন্য প্রাত্যহিক লালন-পালনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রবণ, বুদ্ধি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়কে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসিক সুবিধা রাখা হয়েছে। দেশের অনেক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

 

সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোনো সঠিক পরিসংখ্যান ছিল না। এজন্য ২০১৩ সাল থেকে সরকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে। বিশেষ সুবিধা হিসেবে তাদের কিছু ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করা হয়েছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, অটিস্টিক শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে তারাও প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। এসব শিশুর বিশেষ চাহিদাগুলো মাথায় রেখে তাদের যত্ন নেয়া সম্ভব হলে তারা দেশের অমূল্য সম্পদ হবে। তারাও এ সমাজের অংশ। সবার সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং তাদের প্রতি মায়া-মমতা ও দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। তাদের উন্নয়নে অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার।

 

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ভোরের আকাশকে বলেন, অটিজম সম্পর্কে এখনো দেশের মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে অটিস্টিক শিশুদের ব্যবহারের কারণে পাগল বলা হয়। এমনকি ভুল চিকিৎসা করে অনেক শিশুকে অকালে মেরে ফেলা হয়।

 

তিনি বলেন, অটিস্টিক শিশুরা বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাই এদেরকে প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত না করে বিশেষ শিশু বলা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে অটিজমের হাত থেকে অনেক শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নে অটিস্টিকদের সম্পৃক্ত করা দরকার। একজন প্রতিবন্ধীর জীবনে বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার একটি পর্যায়ক্রমিক ধারা সৃষ্টি করে। প্রায় সব অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীতে এমনকি সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে অবহেলা ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়।

 

তাদের প্রতি অসম দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজে এখনো সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সবার অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

 

দেশের অটিস্টিক ব্যক্তি ও শিশুরা আমাদের আপনজন। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নয়নের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে তারাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। অটিজম মোকাবিলায় সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অটিজমসহ সকল প্রকার শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা মানববৈচিত্র্যেরই অংশ।

 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০০৮ থেকে শিশুদের অটিজম ও স্নায়ুবিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। এছাড়া বাংলাদেশের অটিজমবিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের কাজের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পেয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে তাকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।

 

মনস্তত্তবিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকসের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ২০১৩-এর জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন। সারাবিশ্বেই তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

পুতুলের অনুপ্রেরণায় বেসরকারি পর্যায়েও অনেক প্রতিষ্ঠান অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হয়েছে। অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল কখনো সরাসরি, কখনো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সব জাতীয় কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 

ইতোমধ্যে দেশে অটিজম-সংক্রান্ত বেশকিছু চিকিৎসা সহায়তাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। যেমন ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ওচঘঅ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা; জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইস্টিটিউট, চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা; ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকা; প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট; মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বা মনোরোগবিদ্যা বিভাগ;

 

নিকটস্থ জেলা সদর হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স; সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল; প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version