-->
অভিযুক্ত অর্ধশত পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

সব ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যাত্রী হয়রানি

মোতাহার হোসেন
সব ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যাত্রী হয়রানি

মোতাহার হোসেন: দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যাত্রী হয়রানি, অপেশাদার আচরণ, কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিদেশ থেকে দেশে প্রত্যাগত শ্রমিক, ভ্রমণে যাওয়া যাত্রী, চিকিৎসার জন্য যাওয়া যাত্রীরা দেশে ফিরে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের হাতে হয়রানি, নাজেহাল হয়।

 

এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত ইমিগ্রেশন শাখায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে এ ধরনের অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। খবর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের।

 

ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, দায়িত্বে অবহেলা, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, যাত্রীদের মালামাল তছরুপ প্রভৃতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় এ পর্যন্ত অর্ধশত পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই শাস্তির মধ্যে রয়েছে চাকরি থেকে বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, পদাবনতি, আর্থিক দন্ড, তিরস্কার ও সতর্ক করা হয়।

 

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইমিগ্রেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে, যাত্রী হয়রানি ও অপেশাদার আচরণ যে-ই করুক, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে ক্লোজ ও পরে বিভাগীয় তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ রকম সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

 

অন্যদিকে, যাত্রী হয়রানি বন্ধসহ সকল প্রকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এ সংখ্যা আরো বাড়ানোর উদ্যোগ রয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের। দেশের সব চেকপোস্টে সিসি ক্যামরা স্থাপন করা হলে দায়িত্বরত কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তাদের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

 

সূত্র জানায়, ইমিগ্রেশনে দায়িত্ব পালনকালে কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার দায় নেবে না ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনীর নয় বলে বলেও মন্তব্য ওই কর্মকর্তার। এক্ষেত্রে ২০১১ সালে স্থাপিত সার্ভার সিস্টেম আরো আধুনিক করলে বিমানবন্দরসহ ইমিগ্রেশনের যেকোনো ধরনের অপরাধ উদ্ঘাটনে আরো সহায়ক হবে।

 

পুরোনো তথ্যপ্রযুক্তির কারণে অনেক স্থানে নিরাপত্তা মনিটর করা কষ্টকর হচ্ছে। ইমিগ্রেশনে জনবলসহ সব তথ্যপ্রযুক্তি আরো বাড়ালে অপরাধ কমে যাবে। আর অপরাধীরা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আসবেন।

 

ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেট বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন বিদেশ থেকে যাত্রী আসে ও বহু যাত্রী বিদেশে যায়। এর মধ্যে শুধু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দিনে গড়ে ২৫ হাজার যাত্রী বিদেশে যায় ও বিদেশ থেকে ২৫ হাজার যাত্রী আসে। এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যাত্রীও রয়েছে।

 

এসব যাত্রী বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে সেখানে অনেক ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্য যাত্রীদের সঙ্গে অপেশাদার আচরণ করে। আবার কেউ নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অপরাধের আশ্রয় নেয়। তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে অনেক সময় অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আবার কেউ কেউ অপেশাদার আচরণ করে।

 

এসব অভিযোগের কারণে ইমিগ্রেশন পুলিশের ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তা থেকে কনস্টেবল, এএসআই, এসআইসহ অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ক্লোজ করে বিভাগীয় তদন্ত করা হচ্ছে।

 

ইমিগ্রেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে ভালো আচরণ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের সঙ্গে তারা যাতে ভালো আচরণ করে তার জন্য তাদের নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও কেউ কেউ অপেশাদার আচরণ ও কর্তব্যে গাফিলতি করে। আবার কেউ ইচ্ছা করে ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে যাত্রীদের হয়রানি করে। এসব ঘটনায় গত এক বছরে অর্ধশত পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

 

শাহজালাল বিমানবন্দর ছাড়াও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে দিনে গড়ে ১৪০০ যাত্রী যাতায়াত করে। আর সিলেটে দিনে প্রায় ৭০০ যাত্রী যাতায়াত করে। এই তিনটি বিমানবন্দর ঘিরে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সর্বক্ষণ পালাক্রমে মনিটরিং করছে। কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এরপর অভিযোগ গুরুতর হলে ক্লোজ করে বিভাগীয় তদন্ত করে অপরপাধ প্রমাণ হলে শাস্তি দেয়া হয়।

 

সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ তিনটি বিমানবন্দরে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে বর্তমানে যে সার্ভার প্রযুক্তি রয়েছে, তা ২০১১ সালের। এ প্রযুক্তি ও নতুন নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করলে পুরো সিস্টেমে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

 

সূত্র জানায়, দেশের তিনটি বিমানবন্দর ছাড়াও ২টি সমুদ্রবন্দর, ২২টি স্থলবন্দর রয়েছে। ওইসব স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী হয়রানি ঠেকাতে কড়া নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এরপরও পুলিশের ইমিগ্রেশনের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেলে ওই সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এরপরও অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে প্রমাণের অভাবে অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।

 

মানবপাচার, আদম বেপারীদের প্রলোভনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই কিছু বাড়তি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। যার কোনো প্রমাণ পাওয়া কষ্টকর। তবে প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আবার অনেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে টাকা নিয়ে বিদেশে লোক পাঠানোর নামে মানবপাচার করার চেষ্টা করে। এসব বিষয় এখন কড়াকড়ি করা হয়েছে।

 

ইমিগ্রেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ইমিগ্রেশন পুলিশের কেউ অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, যা অন্য কোনো সংস্থায় নেই। এত শাস্তি অন্য কোনো ইউনিটে নেই। তারা ৫০ জন পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।

 

তার মধ্যে কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্ত, চাকরিচ্যুত, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, পদাবনতি, আর্থিক দন্ড, ইনক্রিমেন্ট কমিয়ে দেয়া, তিরস্কার করা, সতর্ক করা। সাময়িক সাসপেন্ডসহ পুলিশি আইনে বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version