রুদ্র মিজান: দেশের মোট ধানের এক-পঞ্চমাংশ উৎপাদন হয় হাওরাঞ্চলে। গত বছর অকাল বন্যায় ডুবে যায় সোনালি ফসল। ভয়াবহ ওই বন্যায় ভেসে যায় মানুষের আশ্রয়স্থলও। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাওরাঞ্চলের মানুষ। এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এ বিষয়ে তদন্ত করে ফসল তলিয়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিটি। কিন্তু স্থানীয় কমিটির সুপারিশ ফাইলবন্দি হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। হাওরের কাজে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। সব মিলিয়ে এবারো হুমকির মুখে হাওরের ধান।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে হাওরাঞ্চল। এ অঞ্চল ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এই মেঘালয়েই অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান চেরাপুঞ্জি। যা বাংলাদেশের সীমানা থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে।
যে কারণে বন্যার হুমকির মুখে থাকে এ অঞ্চল। প্রায়ই ধান কাটার মৌসুম চৈত্র-বৈশাখ মাসে ভারতের পাহাড়ি ঢলে বন্যা সৃষ্টি হয় এ এলাকায়। হাওরাঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৩৭ হাওর রয়েছে। যার আয়তন আট হাজার বর্গকিলোমিটার।
চৈত্রের শেষে ও বৈশাখের শুরুর দিকে সাধারণত আগাম বন্যা সৃষ্টি হয় হাওর এলাকায়। যে ধান চাষ হয়, তা সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুর দিকেই কাটা শেষ হয়। ওই সময়ে বন্যা মোকাবিলার জন্য ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গত বছর বন্যায় ফসল তলিয়ে গেলে এ বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। হাওরাঞ্চল পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে কমিটি একটি প্রতিবেদন দেয়।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উজানে অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি নদী ও হাওরের তলদেশে পলি জমে ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে খালিয়াজুড়ি পর্যন্ত নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর সমতলের ঢাল খুবই কম। আবার চামড়া ঘাট থেকে ভৈরব পর্যন্ত ঘোড়া উতরাও মেঘনা নদীতে সমতলের ঢাল বেশ কম।
ফসল রক্ষা ও বন্যা মোকাবিলায় বেশ কিছু সুপারিশ করে ওই কমিটি। টেকসই বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য নদীতে ক্যাপিটাল মেইন্টেইন্যান্স ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফেরানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এতে আরো উল্লেখ করা হয়, চেরাপুঞ্জির নিকটবর্তী কয়েকটি হাওরে ধান চাষ না করে স্থায়ীভাবে জলাধার তৈরি করলে বন্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
বর্ষার শুরুতে ও শেষে বাঁধ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেটে ফেলা রোধে ও নৌ-চলাচল নির্বিঘ্নে করতে পর্যাপ্ত কজওয়ে বা ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ করতে হবে। পানির প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য বাঁধের এলাইনমেন্ট পরিবর্তন করে নদীতীর থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে নিয়ে যেতে হবে। বাঁধের ঢাল ১:৩ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জিও টেক্সটাইল, জিওব্যাগ বা সিসি ব্লক ব্যবহার করতে হবে।
বাঁধ নির্মাণ কাজের তদারকির জন্য মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এপ্রিলের ৩০ তারিখের মধ্যে ধান কেটে ফেলতে হবে। এজন্য হাওর শুকিয়ে ফসল তাড়াতাড়ি রোপণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এছাড়াও স্বল্প জীবনকালবিশিষ্ট ধান রোপণে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। বর্ষায় হাওর লিজ না দিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে হাওরের জমির মালিকদের সমন্বয়ে সমিতি গঠন করে মৎস্য চাষ করলে ভালো হয়। মৎস্য চাষি ও ধান চাষি একই হলে হাওর ব্যবস্থাপনা সহজ হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রায় পাঁচ বছর পরপর আগাম বন্যা আসে। ফসল তলিয়ে যায়। এটাকে প্রাকৃতিক চক্র হিসেবে অভিহিত করেছে কমিটি। উজান থেকে আসা বিপুল জলরাশি হাওরের চতুর্দিকে নদীতে সীমাবদ্ধ রাখা কঠিন। এ বাস্তবতায় পাঁচ বছর পরপর আগাম বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই হাওরে বন্যা মোকাবিলার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের বাসিন্দা তসলিম উদ্দিন জানান, বাঁধ নির্মাণে কোনো পরিবর্তন দেখেননি। তবে বাঁধ নির্মাণের কমিটিতে পরিবর্তন এসেছে। অনেক স্থানে ইতোমধ্যে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। তারা জানান, বাঁধ নির্মাণ হলেও অনেক স্থানে যথাযথভাবে হয়নি। বাঁধের উচ্চতা, মাটির পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর বাসিন্দা আনিসুর রহমান জানান, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি না হলেও বাঁধ নির্মাণ করে ফসল রক্ষা করা কঠিন। একইভাবে সুনামগঞ্জের মঞ্জুর মিয়া বলেন, গত বছর উজান থেকে আসা বিপুল জলরাশির কারণে যেমন বন্যা হয়েছিল, তেমনি অপরিকল্পিতভাবে হাওরে নির্মিত বাঁধগুলো ছিল অন্যতম কারণ। এসব বাঁধ কেটে নদী খনন করা প্রয়োজন বলেই মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ব বিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আলী বলেন, ১৯৮৭-৮৮ সালের দুটি প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এরপর বিভিন্ন সময় ডেল্টা প্ল্যান, ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও শুধু বন্যা নিয়ে কোনো কাজ করা হয়নি।
এ নিয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
২০১৭ সালে অকাল বন্যায় শতভাগ ফসলহানির পর ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা গঠন করে সরকার। এতে ঠিকাদারি প্রথা বাদ দিয়ে স্থানীয় কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পিআইসির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের নিয়ম করা হয়। কিন্তু পিআইসিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আধিপত্য থাকায় এ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়।
সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, স্থানীয় গণ্যমান্য চারজনকে নিয়ে আগে পিআইসি গঠন করা হতো। এবার তিনজনকে যুক্ত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিক্ষক, একজন ইউপি সদস্য।
বাঁধ নির্মাণে এবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০০ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এবার যথাযথভাবে ফসল উত্তোলন সম্ভব হবে। আশা করছেন, শুধু সুনামগঞ্জ থেকে ২ লাখ ২২ হাজার টন ধান উৎপাদন হবে। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্পর্কে মামুন হাওলাদার বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে আরো সময় লাগবে।
তবু কিছু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আমরা জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করেছি। অন্যান্য সুপারিশ বাস্তবায়নে আরো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে বারবার চেষ্টা করেও পাউবোর মহাপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম সরকারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য