ইমরান খান: এখনো কোথাও রয়েছে ছাইচাপা আগুন। ধোঁয়া বের হচ্ছে। আগুন জ¦লছে সর্বস্ব হারানো ব্যবসায়ীদের বুকেও। ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া মালামাল হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তারা। পুড়ে যাওয়া কাপড় হাতে নিয়ে চোখের জল ফেলছেন অনেকে। পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বেচাকেনার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। নিজ নিজ দোকানে বিপুল টাকার পণ্য মজুত করেছিলেন বঙ্গবাজারসহ ক্ষতিগ্রস্ত এসব মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মঙ্গলবার লাগা সেই ভয়াবহ আগুন শেষ করে দেয় সবকিছু। সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় বঙ্গবাজারসহ আশপাশের আরে তিনটি মার্কেট। এই আগুন পথে বসিয়ে দিয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীকে। তারা এখন নিঃস্বপ্রায়। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এ ক্ষতি। ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যবসায়ী এখন তাকিয়ে আছেন সরকারি সহযোগিতার দিকে। তারা চান দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঈদের আগেই বঙ্গবাজারে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হোক তাদের। এদিকে, পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানসহ ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে এই কমিটি।
বুধবার দুপুরে ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপে কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে। ধোঁয়া ও আগুনের মধ্যেই জ্বলে যাওয়া দোকান দেখতে ঘটনাস্থলে এসেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী আজগর হোসেন। পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই কাঁদছিলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আগুনের খবর পেয়ে মালগুলো মার্কেট থেকে প্রায় বের করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আগুনের তাপের কারণে মালামাল রাস্তার ওপরে ফেলে যেতে বাধ্য হই। চোখের সামনেই সবকিছু পুড়ে যায়। কিছুদিন আগেই অনেক টাকা ঋণ নিয়ে ঈদের জন্য নতুন করে মাল তুলেছিলাম। এখন সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করব কীভাবে?
তার দোকানের পাশেই আরমান নামের এক তরুণ ও ষাটোধ্বৃ বৃদ্ধা জুলেখা বেগমকে জ্বলন্ত আগুন থেকে পুড়ে যাওয়া কাপড় বের করতে দেখা যায়। কথা হয় সেই বৃদ্ধার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই আগুনের নিচে কিছু কাপড় ভালো মনে হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১০টি প্যান্ট বের করেছি। আগুন নিভে গেলে হয়তো আরো কিছু কাপড় বের করতে পারব। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। কিন্তু এসব কাপড় ওয়াশ করে ফুটপাতে বিক্রি করলেও কয়টা টাকা পামু। এই বৃদ্ধা জানান, এখানে তার ছেলের দোকান ছিল। ঘটনার পর থেকে মানসিকভাবে ভেে ঙ পড়েছে ছেলে। তিনি এসেছেন যদি কিছু পাওয়া যায়। নিজের পুরো পরিচয় দিতে আপত্তি জানিয়ে বৃদ্ধা বলেন, এই দোকানই ছিল আমাদের ছয় সদস্যের পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। আগুন আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। মাত্র সাড়ে ৬ ঘণ্টার মধ্যে আমরা ফকির হয়ে গেলাম। বলেই পরনের কাপড় দিয়ে চোখের জল মুছতে থাকেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দোকানের মালিক ছিলেন ঘটনাস্থলে। কিছুই করার নেই তাদের। নির্বাক তাকিয়ে দেখছিলেন। বঙ্গবাজারের মধ্যেই যেন তারা ঈদের বেচাকেনা করতে পারেন, সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তারা। বঙ্গবাজারের কাপড়ের দোকান ‘মেহরেবা ফ্যাশনে’র মালিক তরিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এখানেই ব্যবসা করতে চাই। ঈদের আগেই মার্কেটটি চালু হলে আমরা কিছুটা ক্ষতি সামাল দিতে পারব।
এদিকে, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের সামনে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন শতাধিক ব্যবসায়ী। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার ভবনের সামনে ‘বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতি’র ব্যানারে মানববন্ধন করেন তারা। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দ্রুত সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে ব্যবসায়ীদের দ্রুত পুনর্বাসন এবং শিগগিরই আবার মার্কেট চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান তারা। দুপুর ১টায় ফায়ার সদর অধিদপ্তরের প্রধান ফটকে বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ব্রিফ করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, এনেক্সকো টাওয়ারের পাঁচ ও ছয় তলায় গোডাউন রয়েছে। সেখানে এখনো মাঝে মাঝে আগুন দেখা যাচ্ছে। সেখানে ফায়ার সদস্যরা কাজ করছেন। মহাপরিচালক বলেন, রাজধানীর সুপার মার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট রয়েছে। আমরা বৃহস্পতিবার থেকে এসব মার্কেটে সার্ভে শুরু করব।
বিকেল ৩টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ সময় তিনি বলেন, ৬টা ১০ মিনিটে যখন আগুন লাগে তার দু-তিন মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। কিন্তু চোখের সামনে আগুন নিমিষেই প্রসারিত হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের এক্সপার্ট কর্মকর্তারা এলেও নানা কারণে তারা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। পাশে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আগুন লেগেছিল। কিছু ক্ষতি পুলিশ হেডকোয়ার্টারেও হয়েছে। কিন্তু আগুনে চারটি মার্কেট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আসন্ন ঈদ টার্গেট করে তারা বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মালামাল তুলেছিলেন। কিন্তু ভয়াবহ আগুনে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রধানমন্ত্রী সব সময় মনিটর করছেন এবং এটি নিয়ে কী করা যায়, পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত তিনি দেবেন।
এদিকে, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গঠিত কমিটি এ বিষয়ে কাজ করছে। আগুনের কারণ, গাফিলতি ও প্রতিকার সম্পর্কে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য