ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজধানী সুপার মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, নিউমার্কেট, চকবাজার ও ঠাঁটারি বাজারের কয়েকটি মার্কেটসহ ঢাকার বেশিরভাগ মার্কেটই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে আছে। বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিস, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (জিজিএফআই) একটি সমন্বিত দল গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করে।
পরিদর্শন শেষে পরিদর্শক দলের প্রধান ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স ঢাকা সদর জোন-১-এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. বজলুর রশিদ এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মার্কেটগুলো ফায়ার সার্ভিসের চাহিদা ফুলফিল করতে পারেনি। ঢাকার বেশিরভাগ মার্কেটই আমাদের চোখে ঝুঁকিপূর্ণ। গাউছিয়া মার্কেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মার্কেটের ছয়টি সিঁড়ি রয়েছে, কিন্তু সিঁড়িগুলো উন্মুক্ত নয়। দোকান বসার কারণে সবগুলোই অপ্রশস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এসব সিঁড়ি দিয়ে পর্যাপ্ত মানুষ নামতে পারবে না। বৈদ্যুতিক তার যেখানে-সেখানে ঝুলে রয়েছে। এছাড়া মার্কেটটিতে স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্ম ব্যবস্থা স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল, সেটিও এখনো করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, এ মার্কেটে ৪৩০টি দোকান রয়েছে। মার্কেটের ওপরের তলাগুলোতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের অফিস ও গুদাম। মার্কেটে ফায়ার এক্সটিংগুইশার আছে, এছাড়া যা যা থাকা দরকার তা নেই।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে মার্কেটটিতে একটি মহড়া হয়েছিল। মহড়া শেষে বেশ কিছু সুপারিশ দেয়া হয়েছিল, যার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাতে কাজ করবে, সেজন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও এখানে নেই। রিজার্ভ পানি থাকলেও সেটা পর্যাপ্ত নয়। এ মার্কেটে ফায়ার টিম আছে বলে জানিয়েছে মালিক সমিতি, তবে তার অস্তিত্ব পাইনি। এ সময় গাউছিয়া মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ মোহাম্মদ কামরুল হাসান বাবু বলেন, দুই বছর আগে ফায়ার সার্ভিস যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা পরিপূর্ণ করেছি। আমাদের ফায়ার সার্টিফিকেট আছে। এছাড়া সব ভবনেই কিছু ত্রুটি থাকে, আমাদের এখানে আউটডোরসহ যে ত্রুটি আছে তা দু-এক দিনের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করব।
সিঁড়ির মধ্যে দোকান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব দোকান বসাতে সমিতির কোনো দায় নেই। কর্তৃপক্ষ যাদের দোকান বরাদ্দ দিয়েছে তারা জানেন এ বিষয়ে। সমিতির সভাপতি হিসেবে দোকান বরাদ্দ দেয়ার কাজ আমার না। এরপরও ফায়ার সার্ভিস এসব দোকান সরাতে বলছে, আমরা কমিটির সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেব। ‘এখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো প্যানেল বোর্ড নেই, এই বোর্ড থাকলে একটি ঘরে বসেই দেখা যায় কোথায় আগুন লেগেছে। মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নিজেদের অগ্নিনির্বাপণী জনবল গড়ে তুলতে বলা হয়েছিল, যেটি এখনো দৃশ্যমান হয়নি।’ ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত সাততলা এই মার্কেটে ৪৩০টি দোকান রয়েছে। বেশিরভাগই নারীদের পোশাক, জরি, লেইস, গয়না, ব্যাগ, জুতা ও কসমেটিকসের দোকান। মার্কেটের ওপরের তলাগুলোতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের অফিস ও গুদাম। তিন বছর আগে এই মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণী মহড়া দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস।
বজলুর রশিদ জানান, তখন ব্যবসায়ীদের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। যেগুলোর অনেকগুলোই তারা পালন করেছেন। ‘এই মার্কেটে ৬০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্থাপন করা হয়েছে বলে তারা (ব্যবসায়ীরা) আমাদের জানিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ঘুরে দেখেছেন সেগুলোর মেয়াদ আছে এবং সেগুলোর মনোমিটারে পর্যাপ্ত প্রেসার শো করছে। তবে আপনারা দেখেছেন, বঙ্গবাজারে আগুন লাগার ফর ফায়ার সার্ভিসকে পানির সংকটে পড়তে হয়েছিল। সেজন্য এই মার্কেটে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল, যা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তবে তারা জানিয়েছেন, তারা একটি ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভার স্থাপন করেছেন। এখানে পর্যাপ্ত পানি থাকতে হবে বলে আমরা তাদের জানিয়েছি।’
গাউছিয়া মার্কেটের যে ছয়টি সিঁড়ি রয়েছে, দোকান বসার কারণে সবগুলোই অপ্রশস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এসব সিঁড়ি দিয়ে পর্যাপ্ত মানুষ নামতে পারবে না বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক বজলুর। ‘যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এই সিঁড়িগুলো দিয়ে পর্যাপ্ত মানুষ নামতে পারবে না। আর সিঁড়িতে যদি আগুন লেগে যায় তাহলে সেই সিঁড়ি ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। তাই সিঁড়ি খালি রাখা বাঞ্ছনীয়।’ সিঁড়িতে বসা রোমিও-জুলিয়েট নামে একটি পোশাকের দোকানের কর্মীরা জানান, তারা সেখানে প্রায় ২০-২৫ বছর ধরেই আছেন। সিঁড়ির মাঝে হলেও দোকানের পজিশন ও ভাড়ার অঙ্ক কম নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাউছিয়া মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল হাসান বাবু বলেন, ‘মার্কেট তৈরির সময় থেকেই এই সিঁড়ির দোকানগুলো রয়েছে। আমরা এগুলো বরাদ্দ দিইনি।’ তিন বছর আগে ফায়ার সার্ভিস যে পরামর্শ দিয়েছিল, সে অনুযায়ী ‘শতভাগ ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টার’ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মার্কেটের বৈদ্যুতিক লাইন শতভাগ তাদের (ফায়ার সার্ভিস) পরামর্শ মতো উন্নত করা হয়েছে, বসানো হয়েছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার। তারা এখন যে পরামর্শগুলো দিয়ে যাচ্ছেন, সেগুলো আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’
ভয়াবহ আগুনে ঢাকার কাপড়ের সবচেয়ে বড় মার্কেট বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হওয়ার পরদিন বুধবার ফায়ার সার্ভিস জানায়, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলোয় জরিপ চালাবে তারা। কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিন গতকাল গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ও অন্যদের সমন্বয়ে গঠিত টিম, যারা ব্যস্ত এই মার্কেটকে আগে থেকেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ মনে করে আসছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সদর দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে রাজধানী সুপার মার্কেট, গাউছিয়াসহ বেশ কিছু মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। গতকাল থেকে এসব মার্কেটে জরিপ শুরু হয়েছে। জরিপের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবেই জানানো হবে।’
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য