-->
এক যুগে ভয়াবহ ৭ অগ্নিকান্ড

সতর্কতা নোটিশ উপেক্ষাই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কারণ

শাহীন রহমান
সতর্কতা নোটিশ উপেক্ষাই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কারণ

শাহীন রহমান: প্রাণহানি না হলেও বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে প্রায় ৫ হাজার দোকানপাট। সে সঙ্গে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। বঙ্গবাজারের আগুন লাগার ঘটনা প্রথম নয়। ১৯৯৫ সালেও ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে একবার ভস্মীভূত হয়েছে। এছাড়া ছোটখাটো একাধিকবার এই মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

 

কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। গত কয়েক বছরে একাধিকবার আগুনের ঘটনা ঘটার পর সতর্কতা নোটিশ দেয়া হলেও তাতে কান দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

 

দেশে শিল্পকারখানাগুলোতে অগ্নিকান্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা রোধে অনেক আগেই ১২ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগ-দপ্তরগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আজ সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে অসতর্কতা, অগ্নিকান্ডের ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়ায় বারবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। টনক নড়ছে না কারও।

 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শক কমিটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়। একই বছরের মে মাসে বঙ্গবাজারের ত্রুটি গুলো তুলে ধরে মার্কেট কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিশ দেয়া হয়। ৩০ দিনের মধ্যে সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

 

নোটিশের ৮ মাস পর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪টি ইউনিট পুনরায় পরিদর্শন করে মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনরায় ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ' বলা হয়।

 

এরপর বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০০৬ এবং অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ মোতাবেক বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিটে অগ্নিপ্রতিরোধ, নির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য মার্কেট কর্তৃপক্ষকে পুনরায় নোটিশ ও নির্দেশ দেয়া হলেও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সতর্কতার নোটিশ উপেক্ষার কারণে বঙ্গবাজারসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায় বারবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে প্রচুর। তবু অগ্নিকান্ড রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বঙ্গবাজােের অগ্নিকান্ডের কিছুদিন আগে ঠিক তার বিপরীত পাশেই একটি মার্কেটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। যাতে ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটে।

 

২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারান ১২৪ জন। একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশের ভবনে। নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন। ঠিক এর ১২ বছর পরে গত বছর সীতাকান্ডের কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪৯ জন নিহত হন।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনার বারবার সূত্রপাত হচ্ছে। সচেতন না হলে আগামীতে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। তারা বলেন, নিমতলীর ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণে ঠিক নয় বছর পরে একই এলাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।

 

এখন অনেকেরই প্রশ্ন, আগের অভিজ্ঞতা থেকে সচেতন বা সতর্ক না হওয়ার কারণে অতীতে যা হয়েছে তাই হচ্ছে। কেবল কিছুদিনের বিরতি মাঝখানে। পুরান ঢাকায় যা হয়েছিল, তারপর কি পরিবর্তন হয়েছে সেখানে তেমন কিছু? আবারো কি একই রকম ঘটনা ঘটবে না? আবারো মানুষ মরবে না যদি একই রকম আগুন লাগে ওখানে? বসতি এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন কি সরেছে? কর্তৃপক্ষকে সে জন্য জবাবদিহি করতে হয়েছে কোথাও?

 

দেশের অগ্নিদুর্ঘটনার ইতিহাসে আরো একটি স্মরণীয় দিন হলো ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল। সারা দেশের মানুষ যখন একুশের ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে জেগে উঠেছিলেন, ঠিক সে সময় পুরান ঢাকার চকবাজারে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারায় ৬৭ জন। সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ থেকেই মূলত ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

 

এ ছাড়া ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার উত্তরে টঙ্গীতে একটি সিগারেট তৈরির কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ হারান ৩১ জন। ওই ভবনের নিচে ছিল রাসায়নিক গুদাম। ফলে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল আগুন।

 

এছাড়াও ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশন ফ্যাক্টরির ৯ তলা ভবনে আগুন লেগে প্রাণ হারান ১১২ জন শ্রমিক। ২০১৭ সালের ৪ জুলাই গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার পেছনে বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন প্রাণ হারান।

 

এদিকে শিল্পে দুর্ঘটনা রোধে মন্ত্রিপরিষদ ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেসব নির্দেশনা আজও কার্যকরা করা হয়নি। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে রয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও বয়লার পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পূর্তকাজে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে অতি জরুরিভিত্তিতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

 

এ টাস্কফোর্স ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কারখানার জন্য প্রযোজ্য সব ধরনের অগ্নি সরঞ্জাম ব্যবহার করে শ্রমিক-কর্মচারীদের ফায়ার ড্রিল নিয়মিতভাবে করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করতে হবে যাতে সেগুলো সবাই ব্যবহার করতে পারে।

 

কারখানায় ২৪ ঘণ্টার জন্য শিফটিং ভিত্তিতে প্রতি ফ্লোরের জন্য আলাদা অগ্নিনির্বাপণ ইউনিট গঠন করতে হবে। দুর্ঘটনার পর যাতে সরঞ্জামসহ সিভিল ডিফেন্স সহজে দুর্ঘটনাকবলিত কারখানায় প্রবেশ করতে পারে সেভাবে কারখানার অবকাঠামো ডিজাইন তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত প্রতিষ্ঠানের মালিকদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ১২ বছর পরও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। আজো পুরান ঢাকা থেকে অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসা চলছে অবাধে। আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, শিল্পকারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া না হলে আবারো একই ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের কারখানা এবং দোকান সেফজোনে সরিয়ে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি কেরানীগঞ্জে কেমিক্যালের সেফজোন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিল। ঢাকার সব রাসায়নিক কারখানা, গুদাম এবং দোকানের জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি এলাকা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়।

 

প্রায় ১২ বছর হলো এই কমিটির সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়েছে কেমিক্যাল পল্লি গড়ে তোলার সেই সুপারিশ। পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, এ ধরনের ঘটনা দেশে বারবার ঘটলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।

 

নিমতলীর ঘটনার পর কমিটির সুপারিশে তখন সবাই সাধুবাদ জানিয়েছিল। আজো এটি সরানো হয়নি। অবহেলার কারণেই এ ধরনের ঘটনা দেশে বারবার ঘটছে। আগামীতেই এ ঘটনা দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন এ ধরনের ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে হলে সরকারের উচিত হবে কঠোর আইন প্রয়োগ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই।

 

অথচ আইন অমান্য করে সবই করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। সরকার জানে, প্রশাসন জানে। অথচ কোনো ব্যবস্থাই তারা গ্রহণ করছে না। তারা বলেন, এর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারলে মিনতলী চকবাজার সীতকুন্ডের পরে অন্য কোথাও একই ঘটনা ঘটবে। ঘটনার রেশও থেমে গেলে মানুষ সব ভুলে যাবে। দায়ীদের শাস্তি হবে না। তদন্ত আলোর মুখ দেখবে না।

 

কিন্তু ক্ষণকাল পরেই এমনি ঘটনা আবারো ঘটবে। কিন্তু কখন, কোথায় ঘটবে তা সময়ই বলে দেবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version