শাহীন রহমান: এবারের চৈত্র মাসের শুরুটা ছিল অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় ভিন্ন। ভারী বৃষ্টিপাত আর কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে সারা দেশের ওপর দিয়ে। ফলে শীত শেষে প্রকৃতি যেখানে বেশ উষ্ণ হয়ে উঠছিল, বৃষ্টিপাতের কারণে স্বস্তির পরিবেশ ফিরেছিল। চৈত্রের শেষে প্রকৃতির এই চরিত্র যেন সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। প্রচণ্ড রোদ আর খরতাপে পুড়ছে সারা দেশ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশের অধিকাংশ জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠান থেকে তাপপ্রবাহের একটি সতর্কবার্তাও দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ২০ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত চলমান এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। চলমান মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহের মধ্যে ঢাকাসহ কিছু জায়গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যেতে পারে। মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চলমান মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহের মধ্যে ঢাকাসহ কিছু জায়গায় থার্মোমিটারের পারদ ৪২ ডিগ্রিতে উঠে যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের দু-এক জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে তীব্র আকারে তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি উঠলে হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। এ কারণে আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, যে হিটওয়েভ চলছে, তা নিয়ে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। এখন যেটি চলছে, সেটিকে আমরা মৃদু থেকে মাঝারি বলছি। কিন্তু এই তাপপ্রবাহ যখন ৪০-৪২ ডিগ্রিতে চলে যাবে, তখন সেটি কিন্তু তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ কারণেই সতর্কবার্তা দেয়া।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ মুহূর্তে বৃষ্টির কোনো আশা নেই। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এপ্রিলের এই গরমে নাজেহাল হচ্ছে সবাই। কাটফাঠা রোদে রোদে টেকা দায়! এই অস্বস্তিকর গরমে বৃষ্টির জন্য হাপিত্যেশ চলছে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা সারা দেশে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চলতি এপ্রিল মাসসহ জুন মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি অবস্থান করছে। সামনে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়াবিদ বজলুর বলেন, দেশে বর্তমানে ‘হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার’ দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। আগামী কয়েকদিনে রাতের তাপমাত্রাও বাড়তে পারে।
আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী তাপমাত্রা বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি হলে সেটিকে মৃদু তাপ্রবাহ, ৩৮-৪০ ডিগ্রি হলে মধ্যমমাত্রার হিটওয়েভ, ৪০-৪২ ডিগ্রি হলে তীব্র বা মারাত্মক এবং ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে অতি তীব্র হিটওয়েভ হিসেবে ধরা হয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে তাপমাত্রার পারদ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে দেশের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার কারণে কৃষি ও মাঠ ফসলের সুরক্ষায় বেশ কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৪৯টি জেলায় মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ১০ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল তা অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি রাখার কথা বলা হয়েছে। আম গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সেচ প্রদান করা, প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করার কথা বলা হয়েছে সতর্ক বার্তায়।
এছাড়া গরমে সবজি রক্ষায় সবজির জমিতে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী ২ থেকে ৩টি সেচের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। ফল ও সবজির চারা তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে গত কয়েক বছর ধরে দাবদাহ বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হয়েছিল বাংলাদেশে এবং ওই দিন দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, একটি জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা সেটি ৫ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং সেটি পরপর পাঁচ দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়। এ হিসাবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে এখন মধ্যমমাত্রার দাবদাহ বইছে। প্রায় একই ধরনের দাবদাহ বইছে রাজশাহীর ওপর দিয়েও।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণায় ৪৪ বছরের তাপমাত্রার একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে- এপ্রিল, মে ও জুন মাসে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়। আবার অগাস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেশের কোনো কোনো জায়গায় বেশ গরম অনুভূত হলেও সেটি তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভের পর্যায়ে যায় না। তবে সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় আবহাওয়া অধিদপ্তর দেখেছে যে, মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কিছুদিন ধরেই আবহাওয়ার ‘বিচিত্র আচরণ’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মার্চ মাসের শেষের দিকে সাধারণত গরম অনুভূত হওয়ার কথা থাকলেও এবার প্রায় সারা দেশেই বৃষ্টির সঙ্গে কালবৈশাখীও বয়ে গেছে। দেশে মার্চ, এপ্রিল ও মে এই তিন মাসকে বর্ষা-পূর্ব মৌসুম হিসেবে ধরে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই তিন মাস সাধারণত স্থানীয়ভাবে বজ্রমেঘ তৈরি হয়ে বৃষ্টি নামায়। কখনো কখনো দেশের বাইরের আশপাশ থেকেও বজ্রমেঘ তৈরি হয়ে এসে দেশের আকাশে পরিপক্বতা লাভ করে। এরপর থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। কিন্তু আবহাওয়া অফিস বলছে, এবারে মার্চ মাসে বেশ ভারী বৃষ্টিপাত ও বজ্রমেঘ তৈরি হয়েছে। যেটার ধরন অন্যবারের চেয়ে আলাদা।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সার্বিকভাবে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠলে শরীর নিজেকে ঠাণ্ডা করার যে প্রক্রিয়া সেটিকে বন্ধ করে দেয়। যে কারণে এর বেশি তাপমাত্রা হলে তা স্বাস্থ্যবান লোকের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে, কিন্তু তার জন্য শীতল তাপমাত্রা হচ্ছে ২০ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। আর বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে মানব শরীরের সহ্যসীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ এর চেয়ে বেশি হলে মানব শরীর সহ্য করতে পারে না। তখন নানারকম অস্বস্তি ও সমস্যা দেখা যায়। এমনকি তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে মানুষের হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি করে পানি ও পানিজাতীয় খাবার খেতে হবে। আর সূর্যের আলো থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। এছাড়া ঘর ঠাণ্ডা রাখা ও ঢিলেঢালা আরামদায়ক সুতি কাপড়ের পোশাক পরিধানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য