-->
শিরোনাম
সোহরাওয়ার্দীতে প্রথম জানাজা

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী

বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ঔষধনীতির রূপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। একজন নিখাদ দেশপ্রেমিকের চিরবিদায়ে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

এছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মঙ্গলবার রাত ১১টার কিছু সময় পর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন ডা. জাফরুল্লাহ। মৃত্যুকালে তার বয়স হলেছিল ৮১ বছর। দীর্ঘদিন তিনি কিডনি রোগসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছিলেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুকালে সহধর্মিণী নারীনেত্রী শিরীন হক এবং দুই পুত্র-কন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

 

এদিকে, বুধবার ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলতাফুন নেছা মায়া বলেন, আজ বৃহস্পতিবার সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রাখা হবে। সেখানে রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। তার প্রথম জানাজা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে।

 

এছাড়া শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আগামীকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ রাখা হবে। পরে জুমার নামাজের পর সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দাফন করা হবে নাকি তার মরণোত্তর দেহ দান করা হবে তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

 

বর্তমানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলতাফ আজিজ, নাগরিক ঐক্যের আহব্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি নাজিম উদ্দিন, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহব্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবুল হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদে গভীর শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ডা. জাফরুল্লাহর অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ডা. জাফরুল্লাহ তার কর্মে বেঁচে থাকবেন।

 

আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুমসহ অনেকে রয়েছেন ।

 

এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক ও সমবেদনা জানানো হয়েছে। সারা দেশের সাধারণ মানুষও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই গুণী মানুষটি চলে যাওয়ায় শোক প্রকাশ করছেন।

 

জীবন ও কর্ম: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যের অন্যতম দিকপাল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। জনস্বার্থ কেন্দ্রে রেখে জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সমাজভিত্তিক জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির রূপরেখা তৈরি করা এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালগুলো তার অবদানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাইলফলক। জাতীয় দুর্যোগ ও রাজনৈতিক সংকটে তিনি সর্বদাই নির্ভীক থেকে সত্য বলে গেছেন। কখনো কখনো হয়েছেন প্রতিবাদী। জীবনের শেষ সময়ে বিশেষ করে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ, সুষ্ঠু নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে কাজ করেছেন।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আবির্ভাব ছিল বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে বিলেত অভিজাত থেকে সার্জন হওয়ার সুযোগ ফেলে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সেই ঘটনা দেশ-বিদেশে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি আবার অস্ত্র রেখে রণাঙ্গনের একটু পেছনে ত্রিপুরা সীমান্তে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। কোনো হাসপাতালের নামে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা যুক্ত হওয়া সেটাই প্রথম। সেই যুদ্ধ হাসপাতালই স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল নামে এখনো সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

 

তিনি শুধু নিজেকেই দেশের সেবায় নিয়োজিত করেননি উদ্বুদ্ধ করেছেন আরো একগুচ্ছ মানুষকে। আজকের বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অনেক মানুষই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রেরণা, তাগাদা এবং দিশা ধরে দেশকে এগিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন দেশের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে। পরবর্তীতে স্বাধীন দেশে হয়ে উঠলেন স্বাস্থ্যসেবা, নারী প্রগতি, গ্রামমুখী পেশাদারি বিকাশের নায়ক। জাফরুল্লাহ চৌধুরী আশির দশকে নামলেন ঔষধশিল্পে নয়ছয় ঠেকাতে জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন করতে।

 

তবে ঔষধনীতির কল্যাণে ওষুধের দাম গরিবের নাগালে এসেছিল। ঔষধশিল্প দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালে তার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্যারামেডিকের ধারণা পরে বিশ্বায়িত হয়। ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বই লিখেছেন : দ্য পলিটিকস অব এসেনসিয়াল ড্রাগ্স।

 

জনস্বাস্থ্য যে গণরাজনীতির কেন্দ্রে থাকা উচিত সেই শিক্ষাটা তিনি শেখালেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশসহ বিশ্বই যখন করোনায় আক্রান্ত হলো সে সময় তিনি আবার দাঁড়ালেন করোনাভাইরাস পরীক্ষা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের গবেষণাকাজে। এছাড়া দেশের কিডনি রোগীদের বড় ভরসাস্থল তাঁর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ডায়ালাইসিস সেন্টার। তার প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয় অনেক নিপীড়িত, অভাবী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার ভরসা হয়ে আছে।

 

নির্লোভ ও নিরাহঙ্কারী জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

 

মুক্তিযুদ্ধে অবদান: বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসে এফআরসিএস পড়াকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চ‚ড়ান্ত পর্ব শেষ না করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্তে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন।

 

এর পর ডা. এম এ মরিনের সঙ্গে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রশিক্ষণ দেন। তার এই অভূতপূর্ব সেবা পদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।

 

পুরস্কার ও সম্মাননা : জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ফিলিপাইন থেকে ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসেবে পরিচিত রাইট লাইভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version