ইমরান খান: সাড়ে ৩ ঘণ্টার আগুনে পুড়েছে রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেট। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের দীর্ঘ চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্যবসায়ীরা মার্কেটে ঢুকে দেখেন ততক্ষণে সবশেষ। অধিকাংশ পোশাকই আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে।
আর যেসব কাপড় আগুনে পোড়েনি সেগুলো পানিতে নষ্ট হয়েছে। এমনকি দোকানে থাকা বিপুল টাকাও পুড়ে ছাই হয়েছে অনেকের। এভাবেই যেন এই আগুনে পুড়েছে নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন। এমন দৃশ্য দেখে হতভম্ব ব্যবসায়ীরা নীরবে চোখের জল ফেলেছেন। চিৎকার করে কেঁদেছেন অনেকে।
এর মধ্যেই উদ্ধার অভিযানে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। তাদের সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন স্বেচ্চাসেবীরাও। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অতিরিক্ত ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, পুলিশ, আনসার ও ভলান্টিয়ারসহ অনেকে। অসুস্থদের ৩১ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে নিউ মার্কেট।
সেহরি ও ফজরের নামাজ শেষে সবাই যখন ঘুমে, ঠিক তখনই ঘটে ঘটনা। ব্যবসায়ীরা ফোনে খবর পান আগুন লেগেছে মার্কেটে। দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান ব্যবসায়ী, কর্মচারীসহ বিপুল মানুষ। ৫টা ৪০ মিনিটে খবর পেয়ে তিন মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছেন দোকানের মালিক-কর্মচারী, পার্শ্ববর্তী ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও পুলিশ সদস্যরাও।
কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তেই থাকে। আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করতে বেশ বেগ হচ্ছিল ফায়ারম্যানদের। পানিবাহী গাড়ি ও ল্যাডার দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছিল। এমনকি ছাদ ফুটো করেও ভবনের ভেতরে পানি দেয়া হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিন কর্মকর্তা, ২১ জন ফায়ার ফাইটার, দুজন ভলান্টিয়ার, দুজন আনসার সদস্য, একজন স্কাউট ও বিমান বাহিনীর একজন সার্জেন্টসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বঙ্গবাজারের মতোই এ মার্কেটের আগুন নেভাতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার শিকার হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একদিকে আগুন জ্বলছে, অন্যদিকে এর মধ্যেই ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছেন নিজেদের মালামাল রক্ষা করতে। এ সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ সদস্য, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মীকে কাঁধে করে ব্যবসায়ীদের মালামাল মার্কেট থেকে বের করে আনতে দেখা যায়। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসারদের সহযোগিতায় কেউ কেউ নিজেদের দোকানের অল্প-স্বল্প মালামাল নিয়ে আসতে পেরেছেন।
কিন্তু তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আগুনে ও পানিতে। দুপুরে সেখানে দেখা গেছে, উৎসুক জনতার ভিড়। এই ভিড় ঠেলে কাজ করতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। এই ভবনটির নিচতলায় কাটা কাপড়। দুই ও তিন তলা পর্যন্ত শার্ট-প্যান্ট, টিশার্ট। চার তলায় বিভিন্ন কারখানা ও দর্জিদের দোকান। এই ভিড়ের মধ্যেই ব্যবসায়ীরা নিচতলা ও দোতলা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক মালামাল সরিয়ে নিতে পেরেছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) আব্দুল আল মাসুম জানিয়েছেন, নিউ সুপার মার্কেটে সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১ হাজার ১০০। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়েও বেশি দোকান রয়েছে মার্কেটটিতে। মার্কেটের তিন তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আহাজারি : নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় সুলতান ফ্যাশন নামের একটি দোকান ছিল আলেয়া নামে এক নারীর। তিনি জানান, প্রায় ৫০ লাখ টাকার বেশি প্যান্ট ছিল তার দোকানে। এর মধ্যে ঈদ উপলক্ষে ১১ লাখ টাকা ঋণ করে কয়েক হাজার প্যান্ট কিনেছিলেন। কিন্তু আগুনে সব পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, আমার তো সব শেষ। এখন ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করব? সংসার চালাব কী করে? রাতের বেলা ফুটওভারব্রিজ ভালো দেখে গেছি। আগুনের খবর পেয়ে এখানে আসার পর দেখলাম সেটি ভাঙা।
ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মার্কেট থেকে বের করে আনা কিছু প্যান্ট-শার্টের পাহারা দিচ্ছেন শারমিন নামের এক নারী। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আমার স্বামী সুমনের প্যান্ট-শার্টের দোকান আছে। সে মালামাল বের করে আনছে। আর আমি এখানে পাহারা দিচ্ছি। অনেকের মালামাল চুরি হয়ে গেছে। যার কারণে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
ব্রিজ থেকে নেমেই দেখা হয় আরিফ নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এ মার্কেটের দোতলায় তার টি-শার্টের দোকান। তার চোখের সামনেই আগুনে পুড়ে দোকানের সব মালামাল শেষ হয়ে গেছে। আরিফ বলেন, কোনোভাবেই সেগুলো রক্ষা করতে পারিনি। ঋণ করে ঈদের জন্য অনেক টাকার মালামাল দোকানে তুলেছিলাম।
শুক্রবার ভালো বিক্রি হয়েছে। রাতে দোকান বন্ধ করেছি। অনেক রাত হওয়ায় কয়েক লাখ টাকা ক্যাশে রেখে গিয়েছিলাম। সর্বনাশা আগুনে সব পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই ব্যবসায়ী। বলেন, কাপড় তো পুড়ে ছাই করে নাই, আমার পোলা-মাইয়ার ভাগ্যরে পুইড়া ছাই করে দিছে।
আগুনের উৎস নিয়ে ধূম্রজাল : আগুনের উৎস নিয়েও তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দু’দিন ধরে নিউমার্কেটেরে ফুট ওভারব্রিজ ভাঙার চেষ্টা করছে সিটি করপোরেশন। তবে ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পিছু সরতে হয় তাদের। শুক্রবার রাতে ব্রিজটি ভেঙে ফেলা হয়। ব্রিজ ভাঙতে গিয়েই মার্কেটে আগুন লেগেছে। নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী ফারুক বলেন, ‘ব্রিজ ভাঙতে যাইয়া শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগছে। মার্কেটের লগে ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়িটা ভাঙছে। সিঁড়ি ভাঙতে গিয়া মার্কেটে আগুন লাগাইছে।’
আরেক দোকানদার বলেন, আমি গত রাত ৪টায় এখান থেকে বেরিয়েছি। তখন তারা দোকান ভাঙতে এসেছে। প্রতিটি ঈদ এলেই তারা এমনটি করে কেন? গেলবারও ঈদের সময় তারা দোকান ভাঙতে এসেছিল। এবার তারা এসে ফ্লাইওভারের সিঁড়ি ভেঙে রেখে গেছে। ক্রেতারা যাতে দোকানে উঠতে-নামতে না পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মো. আবু নাসের বলেন, ব্রিজ ভাঙার কাজ ভোররাত ২টার দিকে শুরু হয় এবং ভোর ৫টার দিকে শেষ হয়। ঘটনাস্থল থেকে ৪০০ ফুট দূরে আগুন লেগেছে। ব্রিজ ভাঙার কাজে গ্যাস কাটার ব্যবহার করা হয়নি। ডিপিডিসির কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ব্রিজটির সিঁড়ির একটি অংশ ভাঙার সময় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তাই ব্রিজ ভাঙার সঙ্গে আগুন লাগার সম্পর্ক নেই।
উদ্ধারকর্মীদের সহযোগিতা করেছেন শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীরা : আগুন নেভাতে গিয়ে ভ্যাপসা গরম আর আগুনের প্রচন্ড তাপে ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের ছটফট করতে দেখা যায়। এমন অবস্থায় উদ্ধার কর্মীদের লেবুর শরবত ও পানি দেন ব্যবসায়ী এবং শিক্ষার্থীরা। নিউ সুপার মার্কেটের নূর চিকেন নামের দোকানের কর্মী মানিক মিয়া বলেন, আমরা লেবু কেটে এবং রুটি দিচ্ছি। ফায়ার ফাইটারসহ সবাই এই খাবার নিতে পারবেন। আমরা দোকানের ১৬ জন কর্মী কাজ করছি। মানুষের পাশে দাঁড়াতে এ উদ্যোগ নিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ফাহমিদা আক্তার বলেন, এখানে অনেকেই পানির জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। কাজ করতে করতে অনেকের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে যারা রোজা রাখতে পারছেন না অথচ আগুন নেভানোর কাজে সহায়তা করছেন তাদের কথা মাথায় রেখেই এ উদ্যোগ নিয়েছি। শরবত আর লেবুর পানি নিয়ে তাদের দিচ্ছি।
উৎসুক জনতার কারণে আগুন নেভানোর কাজ ব্যাহত : ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস। সকাল ১০টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। পরিদর্শন শেষে নিউ মার্কেটের ৪ নম্বর গেটের সামনে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজন ভলান্টিয়ারসহ আমাদের ১২ জন ফায়ার ফাইটার আহত হয়েছেন।
আমাদের মনোযোগ ছিল আগুন নিয়ন্ত্রণের দিকে, মানুষের জানমালের ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে। উৎসুক জনতার ভিড় আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ ব্যাহত করছে। আমি আহব্বান জানাব শুধু এখানকার আগুন নয়, যেকোনো অগ্নিকান্ডের ঘটনায় উৎসুক জনতা ভিড় না করে যদি ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন তবে আমাদের কাজ সহজ হবে। এ সময় ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে জানান ফায়ার ডিজি।
নিউ মার্কেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা : আগুন লাগার ঘটনায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাজধানীর নিউ মার্কেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও আগুনের কারণে শনিবার সকাল থেকে আশপাশের চাঁদনি চক, গাউছিয়া, হকার্স মার্কেট বন্ধ দেখা যায়। নিরাপত্তার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, নিউ মার্কেটের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। সব দোকান মালিকদের নিয়ে এই জায়গায় অবস্থান করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হবে অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে আগুন না নিভবে ততক্ষণ পর্যন্ত মার্কেট খোলা হবে না।
সবার সঙ্গে বসেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনে প্রায় দুইশ দোকান পুড়ে গেছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি দোকানে ২০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার মালামাল ছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এ মুহূর্তে নির্ধারণ করে বলা না গেলেও তা বিপুল।
ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে নিউমার্কেট সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটে। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের প্রাণপণ চেষ্টায় সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার জন্য নিউ মার্কেট এলাকায় র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি ১২ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়।
যোগ দেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরাও। সায়েন্সল্যাব থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত দুই পাশের সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। আগুনের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও ফায়ার সার্ভিস বলছে, ২০১৬ সালেই এই মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে বারবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টদের কাজ করা উচিত বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য