-->
‘হিটশক’ কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি নতুন চ্যালেঞ্জ

অসহনীয় তাপদাহে ঝুঁকিতে বোরো উৎপাদন

মোতাহার হোসেন
অসহনীয় তাপদাহে ঝুঁকিতে বোরো উৎপাদন

মোতাহার হোসেন: বিগত ৭৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে ঢাকাসহ সারা দেশের তাপমাত্রা এবার পৌঁছেছে প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গতকালও চুয়াডাঙ্গাতে ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তীব্র তাপদাহে মানুষ, প্রাণীকূল, পশুপাখীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। তীব্র তাপদাহে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটি চিরে চৌচির। সঙ্গে হাওর, বাঁওড়, পুকুর, খাল-বিল, জলাশয়ের পানি হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। পুকুর, জলাশয়ও শুকিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এ অবস্থায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বোরোতে পানি সেচ দিতে নলকূপ থেকে পানি উঠছে না।

 

সূত্র জানায়, তীব্র তাপদাহে গাছগাছালির সঙ্গে চলমান বোরো মৌসুমে ধানগাছও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় তীব্র তাপদাহে ধানের সবুজ পাতা লাল বর্ণ ধারণ করেছে, ধানের ফুল পুড়ে দানা চিটা হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের প্রধান ফসল বোরো। ফলে আসন্ন বোরো মৌসুমে বোরো উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না, তখনই ধানের জন্য তা হিটশক ঘটে। অর্থাৎ বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়। সে অবস্থা এখন বিরাজ করছে। দেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।

 

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান বলেন, তীব্র তাপদাহের কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। এই হিটশকে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে বোরোর ক্ষেতে মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। তিনি এই হিটশকে বোরো উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন।

 

বোরো মৌসুম শুরু হয় নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শীতের মধ্যে। আর শেষটা হয় চরম গরমে এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা হলে পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ফুল ফোটার সময় এক-দুই ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়। দেশে ২০২১ সালে এ ধরনের হিটশকের ঘটনা ঘটে। ওই বছর প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়।

 

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, তীব্র গরমের কারণে এবার হিটশক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সারা দেশের কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছি। তিনি বলেন, হিটশক ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফুল ফোটা পর্যায়ে) হয়। আমাদের অধিকাংশ ধান এখন সে অবস্থা পেরিয়ে ম্যাচুরিটি স্টেজে এসেছে। তাই হিটশক হলেও খুব ক্ষতি হবে না। তারপরও আমরা সতর্ক থাকতে বলছি।

 

গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারী বলেন, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। হিটশকের ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে এটা ক্ষতি খুব বেশি করে। এ সময়কে সবচেয়ে ভারনারেবল অবস্থা ধরি আমরা। সে সময় গরম বাতাসের কারণে ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে যায়। ফুল শুকিয়ে যায়। ফলে ধান চিটা হয়ে যায়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।

 

হিটশক দেশে নতুন নয় উল্লেখ করে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ শরীরতত্ত¡ বিভাগের পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ২০১২ সাল থেকে আমরা হিটশকের তথ্য রেখেছি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। বড় হিটশক ২০২১ সালে প্রথম হয়।

 

ওই বছর ৪ এপ্রিল একসঙ্গে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলাসহ কিছু অঞ্চলে হিটশক হয়েছিল। এ বছর বৈশাখ মাসেও বৃষ্টি না থাকায় সে আশঙ্কা রয়েছে। বৈশাখী গরম হাওয়া হলে ক্ষতি হয়। সাধারণত কালবৈশাখীর পরে বৃষ্টি হয়। তাই তাপমাত্রা কমে যায়, এমন হয় না। এ বছর সেটা হচ্ছে না।

 

এখন সারা দেশেই তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে কৃষি ও মাঠ ফসলের সুরক্ষায় বেশ কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বিশেষ করে যেখানে এখন ধান ফ্লাওয়ারিং স্টেজে রয়েছে, সেখানে হিটশকের আশঙ্কা বেশি। সে কারণে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। দেশে বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো মৌসুম থেকে। তাই খাদ্য নিরাপত্তায় এ মৌসুমকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় সরকার।

 

চলতি মৌসুমে মোট ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। চাষ করা হচ্ছে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের ধান। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৭২ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি নয় লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রাথমিক তথ্যে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ প্রায় চার শতাংশ বেড়েছে। এ বছর মোট ৪৯ দশমিক ৯৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর বোরো মৌসুমে সফলভাবে ধান ঘরে তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং। কারণ আকস্মিক বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে হাওরের ধান ঠিকমতো ঘরে তোলা নিয়ে প্রতিবছরই আতঙ্কে থাকতে হয় কৃষকদের।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version