-->

শিকড়মুখো মানুষের ভিড় বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে

নিজস্ব প্রতিবেদক
শিকড়মুখো মানুষের ভিড় বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী শনি বা রোববার দেশের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। বুধবার ছিল পবিত্র শবেকদরের সরকারি ছুটি। ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতাবলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তো পবিত্র শবেকদর ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ।

 

ফলে মাহসড়কে ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল। বিশেষ করে গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালীসহ বিভিন্ন দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ডগুলোতে ভিড় দেখা গেছে। তবে অন্যান্য বছরের মতো এবার ছিল না উপচেপড়া ভিড়। ঈদের ছুটি উপলক্ষে যে রকম চাপ থাকার কথা ছিল, সে রকম চাপ দেখা যাচ্ছে না। সকালে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে জনসমাগম কম হলেও বিকেলে ভিড় বাড়ে। অগ্রিম টিকিট বিক্রির কারণে টার্মিনালে কাউন্টারে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন টিকিট বিক্রেতারা।

 

তবে যারা অগ্রিম টিকিট বিক্রি করেনি সেসব কাউন্টারে ভিড় ছিল কিছুটা। বাস কাউন্টারগুলো থেকে টিকিট বিক্রেতারা বলেন, প্রথম দিন উপলক্ষে যে রকম চাপ থাকার কথা ছিল সে রকম চাপ দেখা যাচ্ছে না। ভিন্ন চিত্র ছিল কল্যাণপুরে। উত্তরবঙ্গসহ দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল সেখানে। তবে এবারের ঈদযাত্রায় মহাসড়কে বিশেষ করে পদ্মাসেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেয়ায় বাস বা ট্রেনের ওপর যাত্রীর চাপ কমেছে।

 

তীব্র তাপদাহে উত্তপ্ত শহরে রোদে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন। এর মধ্যেও থেমে নেই ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা। তীব্র রোদ ও গরম উপেক্ষা করেই বাসস্ট্যান্ড, ট্রেন স্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালে ছুটছে মানুষ। যেন ক্লান্তি নেই।

 

 

ঈদযাত্রায় গাড়ির চাপ বেড়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে। আগের দিন বিকেল থেকে এ পথে গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ। গণপরিবহনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলেও বাড়ি যাচ্ছেন অনেকে। সবমিলিয়ে মোটরসাইকেলেই বেশি যাচ্ছে মানুষ। ভোররাত থেকেই সেতুতে মোটরসাইকেল পারাপারে দীর্ঘ সারি ছিল। মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য আলাদা বুথ করা হয়েছে। টোলবুথে শত শত মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েসহ বঙ্গবন্ধু সেতু পার হচ্ছেন মোটরসাইকেলে। যাত্রী কল্যাণ সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ১২ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে করে গ্রামে ফিরেছে।

 

এদিকে স্বস্তির ঈদযাত্রায় যাত্রাবাড়ী ও সায়েদবাদে যানজটে তৈরি হচ্ছে গাড়ির জটলা। ফলে সময়মতো কাউন্টারে গাড়ি পৌঁছাতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, ধোলাইপাড় ঘুরে দেখা গেছে, কাউন্টারগুলোর সামনে দীর্ঘ যানজট।

 

কোনো কোনো গাড়ি সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে। এতে যানজট আরো দীর্ঘ হচ্ছে। পুলিশ বলছে, ঈদযাত্রার কারণে গাড়ির চাপ অনেক বেশি। এছাড়াও সড়কে সংস্কার কাজের জন্য টার্মিনালে গাড়ি দাঁড়াতে না পারায় তৈরি হচ্ছে জটলা। তবে দ্রুত তা সমাধানের উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে।

 

এসব এলাকার সড়কের শৃঙ্খলায় সায়েদাবাদে কন্ট্রোল রুম বসিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। সেখান থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থা। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে অধিকাংশ বাস কাউন্টার সড়কের পাশেই। ফলে রাস্তায় দাঁড়িয়েই সেসব বাসে যাত্রী উঠানো হয়। এসব কারণেই যানজট তৈরি হচ্ছে। ওয়ারী জোনের ট্রাফিক বিভাগ সার্বক্ষণিক কাজ করছে।

 

সদরঘাটে ভিড় : আসন্ন ঈদুল ফিতরের ছুটির প্রথম দিনে রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে। ভোরের আলো না ফুটতেই টার্মিনালে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। যান চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সদরঘাটে যাত্রীর ভাটা পড়ে। যাত্রী সংকটে কমতে শুরু করে লঞ্চের সংখ্যাও। তবে আসন্ন ঈদ সামনে রেখে যাত্রীর চাপ বাড়ায় পুরোনো রূপে ফিরেছে লঞ্চ টার্মিনাল।

 

বুধবার সকালে সরেজমিন লঞ্চ টার্মিনালে দেখা যায়, ঈদের ছুটির প্রথম দিনে নিয়মিতভাবে চলাচলকারী লঞ্চগুলো পূর্ণ যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে। ভোর হতেই টার্মিনালে যাত্রীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে চাঁদপুরগামী যাত্রীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কয়েকদিন আগেও যেখানে যাত্রীর অভাবে নির্দিষ্ট সময়ে লঞ্চ ছাড়ত না, সেখানে এখন লঞ্চগুলো পূর্ণ যাত্রী নিয়ে ঘাট ছাড়ছে। খালি নেই লঞ্চগুলোর কেবিন, ডেকেও দেখা গেছে যাত্রীদের ভিড়।

 

এছাড়া সকালে লঞ্চ না থাকলেও বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, হাতিয়া, পটুয়াখালীগামী যাত্রীদের অনেকেই এসেছেন কেবিন বুকিং দিতে এবং আগেভাগেই ডেকে জায়গা নিতে। এদিকে, যাত্রীদের চাপ বাড়ায় লঞ্চ কেবিনগুলোর ভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান যাত্রীরা। তবে আগে বুকিং দেয়া কেবিনের ভাড়া স্বাভাবিক ছিল। এছাড়া বরিশালগামী লঞ্চগুলোর ভাড়া স্বাভাবিক থাকলেও ভোলাগামী লঞ্চগুলোর ভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বলে জানান যাত্রীরা।

 

সময়মতো ছাড়ছে ট্রেন, নেই চিরচেনা ভিড় : এ বছর ঈদযাত্রায় স্বস্তিতে আছেন ট্রেনযাত্রীরা। টিকিটের জন্য রাতভর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বা ভিড়ের কারণে ট্রেনে ওঠা নিয়ে ঝামেলার চিহ্নমাত্র নেই এবার। এবার ১০ দিন আগে ঈদযাত্রার টিকিট শতভাগ অনলাইনে বিক্রি করার সুফল মিলেছে। এছাড়াও এখন পর্যন্ত ট্রেনে কোনো শিডিউল বিপর্যয় দেখা যায়নি। নির্ধারিত সময়েই সব ট্রেন রাজধানীর কমলাপুর থেকে ছেড়েছে। কমলাপুর ছাড়াও বিমানবন্দর ও গাজীপুরে ছাদে ওঠা ঠেকাতে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছাদে উঠতে দেয়া হচ্ছে না যাত্রীদের।

 

টিকিটবিহীন যাত্রীদের ঠেকাতে স্টেশনে চলছে ৩ স্তরের কড়া চেকিং। এবারই প্রথম ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যার নামে টিকিট, তিনিই ট্রেনে চড়ছেন কিনা, সেটি নিশ্চিত করতে তিন জায়গায় চেক করা হচ্ছে।

 

টিকিটের সঙ্গে এনআইডি মিলিয়ে তারপরেই প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। প্রধান সড়ক থেকে স্টেশনে ঢুকতেই একবার, স্টেশন ভবনের মুখে দ্বিতীয়বার এবং প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার ঠিক আগে আরেকবার টিকিটের সঙ্গে যাত্রীর নাম ও পরিচয় মিলিয়ে দেখছেন রেলওয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা।

 

অন্যান্য বছর দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট কতগুলো দেয়া হবে, তা নির্দিষ্ট ছিল না। কিন্তু এবার ট্রেনে আসন সংখ্যা যত, তার চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। এই স্ট্যান্ডিং টিকিট (ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট) এবং কমিউটার ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হয় ট্রেন ছাড়ার আগে। আর আসনবিহীন এই টিকিটের জন্যও কাউন্টারের সামনে টিকিটপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।

 

ঈদযাত্রা নির্বিঘ্নে পুলিশের বিশেষ প্রস্তুতি : ঈদযাত্রা নির্বিঘ্নে করতে পুলিশের প্রস্তুতি সরজমিনে দেখতে গতকাল বুধবার মহাসড়ক পরিদর্শন করেছেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও হাইওয়ে পুলিশপ্রধান সাহাবুদ্দিন খান দুপুরে মহাসড়ক পরিদর্শনে বাইপাইল ত্রীমোহনা এলাকায় যান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মাহফুজুর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি বরকত উল্লাহ খান, অতিরিক্ত ডিআইজি শ্যামল কুমার, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুলাহ হিল কাফিসহ পুলিশের কর্মকর্তারা।

 

এ সময় সাহাবুদ্দিন খান বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্নে রাখতে আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। আশা করি যাত্রীসাধারণ স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারবেন। তিনি বলেন, টহল বাড়ানো হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সাব কন্ট্রোল-কন্ট্রোল রুম করা হয়েছে। আমাদের অ্যাম্বুলেন্স ও রেকারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

 

এছাড়া এবার একটি বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেটা হলো হাইওয়েতে অনেক সময় গাড়ি বিকল হয়ে যেতে পারে। সে জন্য মহাসড়কের পাশে থাকা গ্যারেজগুলোর একটি তালিকা করা হয়েছে, যেন সড়কে কোনো গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গাড়িটা মেরামত করে সচল করতে পারে। এছাড়াও তীব্র তাপদাহের কারণে যাত্রীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

বিআরটিএ মনিটরিং টিম : ঈদযাত্রা যেন এবার নির্বিঘ্নে হয়, সে জন্য ঢাকার ২০টি পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪৬টি পয়েন্ট নির্ধারণ করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছে বিআরটিএ। যানজটপূর্ণ পয়েন্ট যেখানে, সেখানে দুই শিফটে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ আছে।

 

আমাদের মনিটরিং টিমও কাজ করছে। বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুম থেকে ১৩০টি ক্যামেরার মাধ্যমে যেসব জায়গায় যানজট হয়, সেসব জায়গায় মনিটরিং করা হচ্ছে। কোথাও যানজট হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে বিআরটিএ।

 

পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি বলেন, আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ঈদের আগে ও পরে সাত দিন রাস্তায় থাকবেন, যাতে কোনো ধরনের কোনো সমস্যা না হয়।

 

বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ঈদ যাত্রায় কিছু আনফিট গাড়ি রাস্তায় নামানোর প্রবণতা আছে। এ জন্য আমরা মালিকদের নিয়ে মিটিং করেছি। আইজিপি মহোদয়কে নিয়েও মিটিং হয়েছে, যাতে কোনো আনফিট গাড়ি রাস্তায় না আসতে পারে। গার্মেন্টের আনফিট গাড়িও যেন দূরপাল্লায় না যায়, সে জন্য তাদের সঙ্গে আমরা সভা করেছি। একটা প্রাণও যেন না যায় সে জন্য আমরা সব ধরনের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version